করোনাভাইরাসের প্রকৃত রহস্য
[করোনাভাইরাস : কোত্থেকে ছড়ালো? সত্যিই কি ছোঁয়াচে? সত্যিই কি কোনো ‘ভাইরাস’? মহামারী প্রতিরোধে করণীয়]
আরেকটি প্রশ্নের উত্তর
করোনাভাইরাস যে ছোঁয়াচে নয়, এমনকি এটি কোনো ভাইরাস নয়, এই বিষয়ে এই নিবন্ধের শুরু থেকে এই পর্যন্ত যা আলোচনা করা হয়েছে, তাতে মানুষের নিকট বিষয়টা প্রায় শতভাগ পরিষ্কার হয়ে যাবার কথা। তবু বোঝাবোঝিটা আরো গাঢ় করার জন্য সংশয়বাদীদের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকা একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে রাখতে হয়। প্রশ্নটি কী, তা পরে উল্লেখ করা হবে। আগে উত্তর।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশে, বছরের প্রায় সব সময়, বিশেষ করে ঋতু পরিবর্তনের সময়, এমন অনেক ঘটনা ঘটে, দেখা যায় একটি পরিবারে পাঁচ জন সদস্য। তাদের অনেকেই একই সাথে, বা একজনের পর আরেকজন, বা একজনের পর দুজন, বা দুজনের পর একজন, বা দুজনের পর দুজন নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা এরকম সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যায় আক্রান্ত হয়। আমি যে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি, সেখানে অনেক সময় এমনও দেখা যায়, একটি শ্রেণিতে ৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী। কোনো কোনো দিন তাদের মধ্যে ৪/৫ জন ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হবার কারণে ছুটি নিয়ে চলে যায়। কোনো কোনো দিন দেখা যায় একই শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে অনপুস্থিত। খোঁজ নিয়ে দেখা যায় তাদের বেশিরভাগ সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যায় ভুগছে।
আমাদের পরিবারে পাঁচ জনের বেশি সদস্য। আমার বুঝজ্ঞান হবার পর থেকে এ পর্যন্ত অসংখ্যবার একাধিক সদস্য একই সময়ে বা কাছাকাছি সময়ে সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যায় ভুগেছে। আমাদের শৈশবে আমরা ছয় ভাই বোন যখন বাড়িতেই থাকতাম, দেখা যেতো অনেক সময় আমাদের মধ্যে দু'তিনজন একই সাথে সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যায় ভুগছে। হয়তো কেউ আগে, কেউ পরে আক্রান্ত হয়েছে বা একই সাথে কয়েকজন আক্রান্ত হয়েছে। দু'তিন বছর আগেও আমাদের ঘরে তিনজন একই সাথে সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যায় ভুগেছে। অনেক সময় দেখা গেছে, একজন সুস্থ হবার কয়েক দিন পর আরেকজন সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে।
আমাদের বিদ্যালয়ের অনেক অভিভাবক আমাদেরকে অনেক সময় বলেন, তাঁর ঘরে কয়েকজন একই সাথে সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যা আক্রান্ত। এই বিষয়টা সারা বিশ্বে সাধারণ বিষয়। এই 'একই সাথে বা কাছাকাছি সময়ে একই পরিবারের একাধিক লোকের সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যায় আক্রান্ত হওয়াটা'কে ছোঁয়াচে মনে করা যে ভুল, তা এই নিবন্ধের প্রথম অধ্যায়েই আলোচনা করা হয়েছে।
অনেক সময় দেখা যায় একই পরিবারের কয়েকজন আক্রান্ত, কয়েকজন সুস্থ। ছোঁয়াচে হলে কেউই রক্ষা পেতো না, এমনকি চক্রাকারে পরিবারের সবার রোগটি লেগে থাকতো, একজন থেকে আরেকজন, আরেকজন থেকে আরেকজন, একজন রোগ থেকে সুস্থ হবার পর পরিবারের আক্রান্ত আরেকজনের কাছ থেকে সে আবার আক্রান্ত হয়ে পড়তো, কোনো কালে রোগটি থেকে তারা মুক্তি পেতো না। ছোঁয়াচে নয়, বরং সিজনাল বা ঋতু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট রোগ এগুলো। এজন্য কখনো কখনো দেখা যায় একটি পরিবারে একই সাথে একাধিক সদস্য আক্রান্ত হয়ে পড়েছে, একজনের কাছ থেকে আরেকজন আক্রান্ত হবার কোনো প্রশ্ন ছাড়াই।
নিউমোনিয়া এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যা যে ছোঁয়াচে নয়, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, এমন অসংখ্য ঘটনা সমাজে ঘটে, দেখা যায় একটি পরিবারের একজন এগুলোতে আক্রান্ত হবার পর সুস্থ হবার আগে ঐ পরিবারের আর কেউ এগুলোতে আক্রান্ত হয়নি। একাধিক সদস্য আক্রান্ত হবার তুলনায় শুধু এক সদস্য আক্রান্ত হবার ঘটনা পৃথিবীর সব দেশেই অনেক অনেক বেশি।
আরেকটা প্রমাণ, শৈশবে আমাদের কারো এই জাতীয় রোগ হলে আমাদের মা ২৪ ঘন্টা আমাদের সেবায় নিয়োজিত থাকতেন। কিন্তু খুব কম সময় তিনি আমাদের অসুস্থতার সময় আমাদের সেবা করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। শুধু তিনি নন, আমরা কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাদের বাবাও সব সময় অসুস্থ হয়ে পড়তেন না। এই বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য না করে শুধু একই সাথে একই পরিবারের কয়েকজন সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়ার ঘটনাগুলো দেখেই সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যাকে ছোঁয়াচে মনে করা কি ঠিক হবে? হবে না।
নিবন্ধের প্রথমেই এই সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এটা প্রমাণ করা হয়েছে, নিউমোনিয়া এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যা কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। ছোঁয়াচে রোগ না হওয়া সত্ত্বেও একই সময়ে বা কাছাকাছি সময়ে একই পরিবারের একাধিক সদস্য রোগগুলোতে আক্রান্ত হতে পারে ঐ কারণে, যে কারণে প্রথম সদস্য আক্রান্ত হয়েছে।
এই অনুচ্ছেদের আগের অনুচ্ছেদে এবং এর আগের কয়েকটা অনুচ্ছেদেও এটা স্পষ্ট করা হয়েছে, 'পরীক্ষা পদ্ধতির ত্রুটির কারণে অনেক দেশে অসংখ্য মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে, যারা সত্যিকারার্থে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন না।' করোনাভাইরাসের 'প্রকৃত কারণ' হানা দেয়নি, এমন সব দেশে একই পরিবারের একাধিক সদস্য করোনাভাইরাস পরীক্ষায় পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হবার অনেক ঘটনা ঘটতেই পারে। কিভাবে? যেহেতু একই পরিবারের একাধিক সদস্য অন্য সময়ও সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যায় ভুগে থাকে ছোঁয়াচে হওয়া ছাড়াই, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই সময় সেরকম ঘটনা ঘটবে না কেন? সেরকম ঘটনার ক্ষেত্রে যদি একই পরিবারে সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যায় আক্রান্ত সব রোগীর করোনাভাইরাস পজিটিভ শনাক্ত হয়, তাহলে সেগুলোকে পরীক্ষার ভুল মনে করতে অসুবিধা কোথায়? অন্য সময় যখন একই পরিবারের একাধিক সদস্য একই সময় বা কাছাকাছি সময় সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যা আক্রান্ত হয়, করোনাভাইরাসের এই সময়ও সেরকম হওয়া অসম্ভব হতে পারেনা।
পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন অসংখ্য মানুষের করোনাভাইরাস পজিটিভ শনাক্ত হবার অনেকগুলো ঘটনা এই নিবন্ধে ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, যারা বিগত কয়েক মাসে চীন বা অন্য কোনো দেশে ভ্রমণ করেননি, এমনকি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগীর সাথেও তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এই ঘটনাগুলোকে স্থানীয় সংক্রমণের ঘটনা বলেই বলা হয়েছে সব জায়গায়। কেন এমন ঘটনাগুলো ঘটেছে? করোনাভাইরাস পরীক্ষায় ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতাকে এজন্য দায়ী না করে উপায় থাকে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষত যেসব দেশে করোনাভাইরাসের 'প্রকৃত কারণ' হানা দেয়নি, সেসব দেশে একই পরিবারের একাধিক লোকের করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হওয়াটাকে পরীক্ষার ভুল বলা ছাড়া উপায় নেই। কারণ করোনা যেমন কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়, করোনাভাইরাসের 'প্রকৃত কারণ'ও পৃথিবীর অল্প কয়েকটা দেশেই শুধু হানা দিয়েছে বলে আমরা এই নিবন্ধ থেকে আরো আগেই অবগত হয়েছি। তাই এই অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছা বেশ সহজ হয়ে দাঁড়ায়, করোনা নয়, পৃথিবীর যেসব দেশে করোনাভাইরাসের 'প্রকৃত কারণ' হানা দেয়নি, সেসব দেশে মানুষের সাধারণ সর্দি-জ্বরই পরীক্ষার ভুলে করোনাভাইরাস বলে পরিগণিত হয়েছে।
এবার একটি গল্প
আমার বড় মামার বড় ছেলে। নাম মুহাম্মদ। লক্ষ্মীপুর শহর থেকে প্রধান সড়ক ধরে পূর্ব দিকে চার-পাঁচ কিলোমিটার আসার পর জকসিন বাজার। আরো পূর্ব দিকে এক কিলোমিটার এলে যাদৈয়া নামক একটি স্থান আছে। সেখানে সড়কের দক্ষিণ পাশে একটু ভেতরে আমার নানার বাড়ি। নাম রেয়াজ উদ্দিন ভুঁইয়া বাড়ি। সেদিন আমার ছোট ভাইয়ের কাছে আমার বড় মামার পরিবারে কয়েকজনের সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হবার কথা জেনে বিষয়টা আরো কাছ থেকে জানার জন্য ফোন করলাম মুহাম্মদের কাছে। কুশল বিনিময়ের পর ওকে বিষয়টা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করলাম। সেও উত্তর দিলো। তার উত্তরগুলোর সারাংশ এই, ''আমার বাবা (আমার মামা) কিছুদিন আগে প্রচন্ড জ¦রে আক্রান্ত হয়েছেন। এর পর আমার মেয়েটিও (দু'বছরের কম বয়সী) জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। শুধু প্যারাসিটামল দিয়ে ওদের চিকিৎসা হচ্ছিলো। এরই মধ্যে আমাদের ইব্রাহিমও (মুহাম্মদের দ্বিতীয় ভাই) জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়লো। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। আমরা আশঙ্কা করতে লাগলাম, হয়তো করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এরা সবাই। বিশেষ করে ইব্রাহিমের জ্বরটাকে করোনা বলে বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না। কারণ বিভিন্ন রকম অনেক রোগী যেমন ওর কাছে আসে (একজন গ্রাম্য ডাক্তার হওয়াতে), তেমনি সেও অনেক রোগীকে দেখতে যায়। এদের সবার চিকিৎসা চলতে লাগলো প্যারাসিটামলের পাশাপাশি লেবুর রস ইত্যাদি দিয়ে। কিছু দিনের মধ্যে আমার মেয়ের অবস্থার উন্নতি হলো। বাবার অবস্থা কখনো একটু উন্নতি হয়, আবার মাঝে মাঝে অবনতির দিকেও চলে যায়। কিন্তু ইব্রাহিমের কোনো উন্নতি হচ্ছিলো না। এরই মধ্যে ফারুক (মুহাম্মদের তৃতীয় ভাই) ঢাকা থেকে বাড়িতে আসার পর সেও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তার জ্বরের কারণ হলো, সে ঢাকা থেকে মোটরসাইকেলে আসার পথে কয়েকবার বৃষ্টিতে ভিজেছে। বৃষ্টিতে ভিজেই তার জ্বর হয়েছে। আমার বাবারও জ্বরের কারণ আছে। তিনি গরমের মধ্যে শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করে আসার পর পুকুরে গোসল করেছেন।
তবু ওরা হয়তো সাধারণ জ্বরের পরিবর্তে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ভেবে আমরা ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন ছিলাম। কারণ আমাদের এলাকায় ইতোমধ্যে কয়েকজনের করোনাভাইরাস পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। ইব্রাহিমের অবস্থা একেবারে শোচনীয় হয়ে গেলো। সে দুশ্চিন্তায় খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দিলো। আমরা একবার ভাবলাম, করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়ে আসবো। কিন্তু শেষে তা না করে করোনা পরিষেবার হটলাইন নাম্বারে ফোন করলাম। ওরা লক্ষণ সম্পর্কে জানতে চাইলো। লক্ষণ বলার পর ওরা বললো, 'ভয় পাবেন না। এটা করোনা নয়, বরং সাধারণ সর্দি-জ্বর। আপনারা প্যারাসিটামল খান ৬ ঘন্টা পর পর, বেশি সমস্যা হলে এজিথ্রোমাইসিন খাবেন।'
এই আশ্বাস এবং পরামর্শের পর আমরা সাহস পেলাম। এরপর ইব্রাহিমকে এজিথ্রোমাইসিন খাওয়ানো শুরু করার পর ধীরে ধীরে সে সুস্থ হয়ে উঠলো। তার শরীরে শুধু ক্ষুধামন্দা রয়ে গেলো। পরে তা-ও ভালো হয়ে গেলো। আমার বাবাকে এবং ফারুককে কয়েকদিন শুধু প্যারসিটামল খাওয়ানোর পরই তারা সুস্থ হয়ে উঠলো। এর কিছু দিন পর আমার বাবার আবার জ্বর উঠলো। এবার তাঁকে এজিথ্রোমাইসিন খাওয়ানো শুরু করা হলো। তিনি সুস্থ হয়ে গেলেন। এখন শুধু তাঁর কাশি আছে। মাঝখানে আমারও জ্বর এলো। দু'দিন শুধু প্যারাসিটামল খাওয়ার পরই আমার জ্বর সেরে গেছে, এজিথ্রোমাইসিন বা কোনো অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হয়নি।''
নিজেদের পরিবার সম্পর্কে এই কথাগুলো বলার পর কথায় কথায় মুহাম্মদদের এলাকা প্রসঙ্গে আলোচনা চলে এলো। ওদের এলাকার কয়েকটা ঘটনার কথা সে উল্লেখ করলো। (১) ওর এক চাচা (ওর বাবার চাচাতো ভাই) আনোয়ার ভুঁইয়া, যিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কিছু দিন আগে জ্বরে আক্রান্ত হলেন। চিকিৎসার এক পর্যায়ে নিজ থেকে আগ্রহী হয়ে তিনি করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়ে এলেন। ফলাফল আসার আগে তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলেন। সুস্থ হবার পর ফলাফল আসে তিনি করোনা পজিটিভ! তাঁকে লকডাউনের বন্দীদশায় নিক্ষেপ করা হলো। তাঁর জীবনে এখন চলছে বিভীষিকাময় অবস্থা। এখন তিনি শারীরিকভাবে পুরো সুস্থ, তবে মানসিকভাবে পুরো অসুস্থ! (২) শুধু ওর ওই চাচা আনোয়ার ভুঁইয়া নয়, মান্দারী এলাকায় (মুহাম্মদদের নিকটবর্তী এলাকা) নাকি এরকম আরো ৭/৮ জন রোগী আছে, যারা জ্বরে আক্রান্ত অবস্থায় করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়ে এসেছে। কিন্তু 'করোনা পজিটিভ' ফলাফল আসার আগেই জ্বর থেকে পুরোপুরি সেরে উঠেছে! এখনও ওরা সুস্থ। (৩) যাদৈয়া রাস্তার মাথায় আহমদ সরকার নামে একজন প্রবীণ লোকের বসবাস। তাঁর একটি ছেলে করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হবার কয়েকদিন পর তাঁর করোনা পরীক্ষা করে দেখা যায় তিনিও করোনা পজিটিভ রোগী। কিন্তু বিগত কিছুদিন এলাকায় এবং বাজারে যাদের সংস্পর্শে তিনি গিয়েছেন, যাদের সাথে মিশেছেন, কেউই করোনায় আক্রান্ত হয়নি! (৪) মুহাম্মদের আরেক চাচা কামাল ভুঁইয়া (আনোয়ার ভুঁইয়ার ভাই) কিছুদিন আগে মামুন নামে আরেকজন লোকের সাথে একই মোটরসাইকেলে চড়ে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়ে এলেন। শেষে দেখা যায়, যার সাথে একই মোটরসাইকেলে গিয়েছেন, তিনি করোনা পজিটিভ, আর কামাল ভুঁইয়া করোনা নেগেটিভ! আরো চাঞ্চল্যকর বিষয় হচ্ছে, করোনা নেগেটিভ হয়ে কামাল ভুঁইয়া যেমন এখনও সুস্থ, করোনা পজিটিভ হয়েও মামুন নামক ঐ লোকও সুস্থ! অথচ মামুন লকডাউনে, কামাল বাইরে! (৫) মুহাম্মদের বড় চাচাও (মানে আমার মেঝো মামা) কিছুদিন আগে বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। শেষে মুহাম্মদের ভাই ইব্রাহিম তাঁর চিকিৎসা করতে গিয়ে প্যারাসিটামল খেতে পরামর্শ দেয়ার কয়েকদিন পরও যখন তাঁর জ্বর যাচ্ছিলো না, তখন তাঁকে করোনা পরীক্ষা না করে টাইপয়েড পরীক্ষা করার পরামর্শ দিলো। টাইপয়েড পরীক্ষার পর দেখা গেলো তিনি টাইপয়েডে আক্রান্ত। টাইপয়েডের ঔষধ খাওয়ার পর তিনি এখন পুরো সুস্থ। (৬) মুহাম্মদের চাচা আনোয়ার ভুঁইয়া সম্পর্কে আরেকটি তথ্য দিলো মুহাম্মদ। আনোয়ার ভুঁইয়া করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়ে আসার পর যেদিন ফলাফল এসেছে, তার আগের দিন সন্ধ্যায় একদিন একটি চায়ের দোকানে এলাকার ৫/৬ জন লোকের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছিলেন। মুহাম্মদ কোনো এক দরকারে ঐ দোকানে গিয়ে যখন আনোয়ার ভুঁইয়াকে এই অবস্থায় দেখলো, তখন বললো, কাকা, আপনি করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়ে এসে এখন দোকানে বসে চা খাচ্ছেন, ধূমপান করছেন। এটা কি ঠিক হচ্ছে? আনোয়ার ভুঁইয়া উত্তর দিলেন, আরে আমি তো নমুনা দিয়ে এসেছি এমনি এমনি। মনে হালকা একটা সন্দেহ ছিল বলে। আমার কি করোনা আছে?
কিন্তু শেষে দেখা গেলো তিনি করোনায় পজিটিভ!
একটু বিশ্লেষন করা যাক
মুহাম্মদদের পরিবারে যদি সবার আগে ইব্রাহিম জ্বরে আক্রান্ত হতো, পরে অন্যরা আক্রান্ত হতো, তাহলে ওদের পরিবারের সবার মনে মহা আতঙ্ক বিরাজ করতো। সবাই ভেবে নিতো কোনো করোনায় আক্রান্ত রোগীর সাথে সাক্ষাতের কারণে সে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, এমনকি তার কাছ থেকে ঘরের অন্যদের মধ্যে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। আর যদি ফারুক প্রথমে জ্বরে আক্রান্ত হবার পর ঘরের অন্যরা জ্বরে আক্রান্ত হতো, তখনও সবাই ভেবে নিতো, এটা জ্বর নয়, বরং করোনা। ফারুক ঢাকা থেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এসেছে এবং তার কাছ থেকে ঘরের অন্যরা আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু এই দুইটার কোনোটাই হয়নি।
কিছু প্রশ্ন
(এক) আনোয়ার ভুঁইয়া এবং মান্দারী এলাকার আরো ৭/৮ জন লোক শরীরে জ্বর থাকার সময় করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়ে আসার পর ফলাফল পজিটিভ আসার আগেই সুস্থ হয়ে যাবার ঘটনা কি এই দিকে ইঙ্গিত দেয় না, করোনা পরীক্ষার প্রচলিত নিয়মে করোনায় আক্রান্ত হয়নি, এমন লোকও করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়?
(দুই) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী থেকে কারো শরীরে রোগ না ছড়ানোর জন্য তিন ফুট দূরত্বে থাকার কথা বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হবার পরও কামাল ভুঁইয়া এবং মামুন এরা একই মোটরসাইকেলে একসাথে করোনা পরীক্ষার জন্য যাবার পরও কেন মামুন থেকে কামাল করোনায় আক্রান্ত হলো না? শুধু হ্যান্ডশেক নয়, করোনায় আক্রান্ত কারো সাথে কোলাকুলি করলেও করোনায় আক্রান্ত হবার বিশ্বাসে কি এরকম ঘটনাগুলো ফাটল ধরায় না?
(তিন) আনোয়ার ভুঁইয়া এবং আহমদ সরকার করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়ে লকডাউনে অন্তরীন হবার আগে যাদের সংস্পর্শে গেছেন, তাদের কেউ করোনায় আক্রান্ত না হওয়াটা কি করোনা ছোঁয়াচে না হবার পক্ষে জাজ্বল্যমান উদাহরণ নয়?
(চার) আমার বড় মামার পরিবারে পাঁচ জন লোক সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে কোনো ব্যাকরণ না মেনে। তাঁদের কারোই করোনা হয়নি। যদি তাদের কোনো একজনের করোনা পরীক্ষা করার পর সে পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হতো, তাহলে অন্যরাও ভেবে নিতো তারাও করোনায় আক্রান্ত। হয়তো তাদের সবার করোনা পরীক্ষা করার পর তারাও করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হতো আনোয়ার ভুঁইয়া এবং মান্দারী এলাকার আরো ৭/৮ জন লোকের মতো। শুধু অতি উৎসাহী হয়ে টেস্ট করতে চলে যায়নি বলেই হয়তো তাদের সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যাটি করোনায় পরিণত হয়নি। কিন্তু দেশে দেশে, বিশেষ করে যে দেশগুলোতে করোনার 'মূল কারণ' হানা দেয়নি, সেসব দেশে এরকম একই পরিবারের একাধিক লোকের সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যায় আক্রান্ত হবার যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেসব ঘটনায় করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দেয়ার পর কেউই করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়নি, এমন নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারবে?
মুুহাম্মদদের এলাকায় যারা করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তাদের কেউই করোনায় আক্রান্ত কোনো রোগীর সংশ্রবে যায়নি। যেভাবে বিশ্বের অনেক অনেক দেশে স্থানীয় সংক্রমণের ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেভাবেই ছোঁয়াচে হবার কোনো নামগন্ধ ছাড়াই এরাও উড়ে আসা করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত কোনো দেশে যাওয়া ছাড়াই, এমনকি করোনায় আক্রান্ত কারো সাথে কোনো সম্পর্ক ছাড়াই এভাবে দেশে দেশে অসংখ্য মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এই ঘটনাগুলো পরীক্ষার ভুল হিসেবে ধরে নেয়াটা ভুল হবে কেন?
এমনও হতে পারে, আমার মামার মতো এমন কোনো লোক, যার শরীরে অন্তর্নিহিত রোগ (আগে থেকেই বিদ্যমান কোনো রোগ, যেমন: হৃদরোগ, যক্ষা, ডায়াবেটিস, টাইপয়েড ইত্যাদি) আছে, সে জ্বরে আক্রান্ত হবার পর পরই করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়ে আসার পর তার জ্বর না যেতেই ফলাফল এলো করোনা পজিটিভ। এরপর তাকে লকডাউনে বা আইসোলেশনে নিক্ষেপ করে এন্টিবায়োটিক বাদ দিয়ে (যেহেতু করোনার কোনো চিকিৎসা নেই এবং করোনায় এন্টিবায়োটিকও কার্যকর নয়) সাদামাটাভাবে চিকিৎসা করা হয়, সে শুশ্রূষাহীনতা, মৃত্যু-আতঙ্ক, জ্বরের তীব্রতা, অন্তর্নিহিত রোগের তীব্রতা এবং হতাশা এগুলোর যে কোনো এক বা একাধিক কারণে মারা যেতে পারে। হয়তো পরীক্ষার ভুলেই সে করোনা পজিটিভ হয়েছে। কিন্তু মারা গেছে পরিস্থিতির শিকার হয়ে অন্য কারণে। কেউ বুঝতে বা জানতে পারলো না। সবাই ধরে নিলো করোনাতেই মারা গেছে। এরকম অসংখ্য ঘটনা পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘটে থাকতে পারে। এই ঘটনাগুলো কি করোনাভাইরাসে মৃত্যুর পরোক্ষ কারণ নয়?
দেশে দেশে আমার মামার পরিবারের মতো অসংখ্য পরিবারে একই সাথে বা কাছাকাছি সময়ে কয়েকজন লোকের শরীরে হানা দেয়া ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া এরকম সর্দি-জ্বর জাতীয় সমস্যাগুলো পরীক্ষার ভুলে করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়নি, এমন কোনো নিশ্চয়তা কি দেয়া যাবে? এরকম ঘটনায় কয়েকজনের মধ্যে দু'একজন মারা যাবারা ঘটনাও ঘটেছে। সেই মৃত্যুগুলোকে 'করোনায় মৃত্যুর তালিকা'য় অন্তর্ভক্ত করা কি ঠিক হবে? হবে না।
'আরেকটি প্রশ্নের উত্তর' শিরোনাম দিয়ে এই পরিচ্ছেদ শুরু করা হয়েছে। প্রশ্নটি কী, তা কি এখনো কারো বুঝার বাকি আছে? হ্যাঁ, প্রশ্নটি হলো, 'করোনা যদি ছোঁয়াচে না হয়, তাহলে একই পরিবারের একাধিক সদস্য কেন কখনো কখনো করোনায় আক্রান্ত হয়?'
এখানে ঐসব দেশের প্রেক্ষাপট থেকে উত্তরটি দেয়া হয়েছে, যেসব দেশে করোনার 'মূল কারণ' ঘটেনি। মূল কারণে যেসব দেশে করোনার উপদ্রব দেখা দিয়েছে, সেসব দেশে একই পরিবারের যতজন মানুষ নির্দিষ্ট 'বিষাক্ত বাতাস' এর আওতায় আসার ফলে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে ওই বাতাস গ্রহণ করেছে, তারা সবাই করোনা 'ভাইরাসে' আক্রান্ত হয়েছে। একজনের করোনা আরেকজনের শরীরে ছড়ানোর প্রয়োজন হয়নি। বুঝে নেয়া সহজ। আর এই নিবন্ধে আগেই বুঝিয়ে বলা হয়েছে, একজনের শরীর থেকে কোনো রোগ আরেকজনের শরীরে শূন্যে লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে পারে না। কোনো এলাকার বাতাস বা পানি ইত্যাদি কোনো কারণে দূষিত বা বিষাক্ত হয়ে গেলে ঐ বাতাস বা পানি যে বা যারা গ্রহণ করবে, সে বা তারা কোনো রোগে আক্রান্ত হবে। যারা গ্রহণ করবে না, তারা শুধু 'ঐ রোগে আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে যাওয়া'র কারণে ঐ রোগে আক্রান্ত হতে পারে না। যেহেতু কোনো রোগ উড়তে বা লাফাতে পারে না। রোগ মানুষের অন্ত্রে মিশে থাকে। শুধু রক্তদুষ্টিজনিত রোগগুলো রক্তের মাধ্যমে এক শরীর থেকে আরেক শরীরে প্রবাহিত হতে পারে। আর ভাইরাস? ভাইরাস কিভাবে একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে রোগ ছড়ায়, তা বিজ্ঞান কোনোভাবে রেকর্ড করে দেখাতে পারবে না। অনেকগুলো নিরীক্ষার কথা এই নিবন্ধে এর আগে উল্লেখ করা হয়েছে। এবার একটি চ্যালেঞ্জ। যে রোগগুলোকে বায়ুবাহিত বা ছোঁয়াচে মনে করা হয়, সেই রোগগুলোতে আক্রান্ত ১০ জন রোগীর সাথে ১০ জন সুস্থ রোগী হ্যান্ডশেক করলে ১৪ দিন নয়, ২৪ দিন পরও সুস্থ ১০ জন লোক সবাই ঐ রোগে আক্রান্ত হবে না। দু'একজন 'হতে পারে', নিশ্চিত নয়, না হবার সম্ভাবনাই বেশি। তবু 'হতে পারে' বলা হয়েছে কেন? অসুস্থদের সাথে হ্যান্ডশেক না করলেও এরা আক্রান্ত হতো ঐ কারণে যে কারণে অসুস্থ লোকগুলো ঐ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। শুধু এই চ্যালেঞ্জ সমাজ থেকে চিরতরে দূর করতে পারে 'ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং জীবাণু মানুষের শরীরে রোগ ছড়ানো'র শত বছর ধরে প্রচলিত ধারণা/বিশ্বাস।
যে প্রশ্নের উত্তরের জন্য এই পরিচ্ছেদ, সেই প্রশ্ন করার আগে যেসব পরিবারে একাধিক লোক করোনায় আক্রান্ত, সেসব পরিবারের দিকে লক্ষ্য করার পাশাপাশি ঐসব পরিবারের দিকেও লক্ষ্য রাখা উচিত ছিল, যেসব পরিবারে সবাই করোনায় আক্রান্ত হয়নি; যেমন পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কোনো পরিবারে মাত্র একজন আক্রান্ত হয়েছে, বাকি চার জন আক্রান্ত হয়নি বা চার জন আক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু একজন আক্রান্ত হয়নি। এরকম ঘটনা বেশি খুঁজে পাবেন। আমার মামার পরিবারে করোনা হানা না দেয়া সত্ত্বেও সর্দি-জ্বরেও কিন্তু সবাই আক্রান্ত হয়নি। মুহাম্মদের স্ত্রী এবং আমার মামি বাকি ছিল! খুব কম পরিবার পাবেন, যেখানে পরিবারের এ-টু জেড সবাই করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। একই পরিবারের একাধিক মানুষের আক্রান্ত হবার ঘটনাগুলো এই দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখা উচিত, ওই পরিবারের কেউ করোনার হামলা থেকে রক্ষা পেয়েছে কিনা! একটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে অকারণে নিজেকে অস্থিরতায় ফেলবেন না!
নিবন্ধটির মূল আলোচ্য বিষয়ে যাবার আগে আরো কয়েকটা বিষয়ে আলোচনা করে নেয়া হোক:
আগে আমরা কিছু উদাহরণ দেখি যেগুলো দেখলে মনে হবে, করোনাভাইরাস সত্যিই ছোঁয়াচে নয়।