করোনাভাইরাসের প্রকৃত রহস্য
[করোনাভাইরাস : কোত্থেকে ছড়ালো? সত্যিই কি ছোঁয়াচে? সত্যিই কি কোনো ‘ভাইরাস’? মহামারী প্রতিরোধে করণীয়]
করোনাভাইরাস ছোঁয়াচে না হবার পক্ষে কিছু উদাহরণ
করোনাভাইরাস ছোঁয়াচে নয়, এই কথার পক্ষে এর আগেও অনেক উদাহরণ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমতঃ এমন অনেক ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলোতে দেখা যাচ্ছে, চীনের উহান থেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অন্য কোনো দেশে গিয়েও সেখানে তার কাছ থেকে করোনাভাইরাস ছড়ায়নি বা চীন ফেরত লোকেরা সেই দেশের 'পেশেন্ট জিরো'তে পরিণত হয়নি। দ্বিতীয়তঃ চীন ছাড়া অন্য অনেক দেশে অসংখ্য মানুষ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে স্থানীয়ভাবে; চীন বা করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আছে, এমন কোনো দেশে ভ্রমণের ইতিহাস ছাড়া এবং নিজের দেশে অন্য দেশ থেকে আগত কোনো করোনাভাইরাসের রোগীর সাথে কোনোরকম সম্পর্ক ছাড়া।
বাকি আছে শুধু এমন উদাহরণ, যেখানে দেখা যাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কারো সাথে সংস্পর্শের পরও মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি। এরকম উদাহরণ খুঁজে নেয়াটা বেশ কষ্টকর। কারণ করোনাভাইরাস একটি ছোঁয়াচে রোগ হিসেবে ভয়ানকভাবে বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে গিয়ে নতুন কেউ করোনায় আক্রান্ত হবার ঘটনাগুলোর দিকেই নজর ছিল সবার, কিন্তু করোনায় আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে গিয়েও করোনায় আক্রান্ত হয়নি, এরকম অসংখ্য ঘটনা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সংঘটিত হবার পরও ঘটনাগুলোকে মাথায় প্রোথিত বিশ্বাসের (করোনা একটি ছোঁয়াচে রোগ) সাথে সাংঘর্ষিক দেখার পর এর পক্ষে কোনো ব্যাখ্যা না পেয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে ভেবে প্রকাশ করা হয়নি। সবকিছুর পরও দু'একটা সত্য প্রকাশিত হয়েই যায়। দেখা যাক অল্প কিছু উদাহরণ:
(এক) 'South Korea reports 10th COVID-19 death, 144 new cases' শিরোনামে চ্যানেল নিউজ এশিয়ার ওয়েবসাইটে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, 'The Korea Centers for Disease Control and Prevention (KCDC) confirmed 144 new infections, taking the tally to 977, the largest national total anywhere outside China, where the virus first emerged.
More than 80 per cent of the infections have been in South Korea's fourth-largest city Daegu and neighbouring North Gyeongsang province. ...
The leader of the main opposition United Future party Hwang Kyo-ahn had to be tested along with other senior party officials as they had come into contact with the patient, but all tested negative.' [https://www.channelnewsasia.com/news/asia/south-korea-covid-19-deaths-virus-feb-25-12467816]
(দুই) 'সিঙ্গাপুরে কোয়ারেন্টাইনে থাকা ১৯ জনের মধ্যে ১০ জনই বাংলাদেশি' শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, 'করোনাভাইরাসে আক্রান্ত দুই বাংলাদেশি এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন সিঙ্গাপুরে। এদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। প্রথম যিনি শনাক্ত হয়েছিলেন, দ্বিতীয় শনাক্ত হওয়া ব্যক্তি তার সংস্পর্শেই ছিলেন। এ তথ্য জানিয়েছেন জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।
তিনি জানান, এই দুই রোগীর সংস্পর্শে ছিলেন এমন ১৯ জনকে কোয়ারেন্টাইনে রেখেছে সিঙ্গাপুর সরকার। এর মধ্যে ১০ জনই বাংলাদেশি।
বুধবার করোনাভাইরাস নিয়ে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি নতুন এ তথ্য দেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর।
সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত দুজনের বিষয়ে আরও বলেন, তারা দুজনই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে একজন আইসিইউতে রয়েছেন, আরেকজন সাধারণভাবে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সিঙ্গাপুর সরকার তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে, তারা নিয়মিতভাবে আমাদের দূতাবাস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। আর দূতাবাস এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে।
তবে এই দুই রোগীর সংস্পর্শে আসা ১৯ জনের আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। তাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের জন্যই কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে ১০ জন বাংলাদেশি। তাদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।' [https://www.jugantor.com/national/277971]
(তিন) 'করোনা পজিটিভ স্বামীর সেবা করেও স্ত্রীর নেগেটিভ!' শিরোনামে দৈনিক কালের কন্ঠে ৮ এপ্রিল, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, 'করোনাভাইরাস পজিটিভ নিয়ে বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আইসোলেশনে ভর্তি রংপুরের সেই শ্রমজীবী ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার পরও তাঁর স্ত্রীর শরীরে করোনার উপস্থিতি মেলেনি। ওই ব্যক্তির সঙ্গে হাসপাতালে এক সপ্তাহ ধরে অবস্থান করছিলেন স্ত্রী। কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই স্বামীর সেবাও করেছেন তিনি। এর পরও পরীক্ষায় করোনা নেগেটিভ আসার ঘটনাটিকে মিরাকল বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।' [https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2020/04/08/896107]
(চার) 'করোনাভাইরাস: সংক্রমণ রোধে যেভাবে কাজ করেছেন সিঙ্গাপুরের গোয়েন্দারা' শিরোনামে ২১ মার্চ ২০২০ বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, 'প্রথমদিকে যে কয়েকটি দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে, সিঙ্গাপুর তার মধ্যে একটি। সেখানে গোয়েন্দারা সম্ভাব্য ভাইরাস সংক্রমণের শিকার ব্যক্তি শনাক্ত করার চেষ্টা করছে যেন ভাইরাসের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকতে পারেন তারা।
তারা কীভাবে এই কাজ করছেন? বিশ্বের বাকি জায়গাগুলো কী এই ধরণের পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে দেরি করে ফেলেছে?
জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে চীনের গুয়াংশি শহর থেকে ২০ জন পর্যটকের একটি দল চীনা নববর্ষ উদযাপনের জন্য সিঙ্গাপুর সফর করে। দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় কয়েকটি জায়গা ভ্রমণ করে তারা।
তারা চীনা প্রথাগত একটি ওষুধের দোকানও ভ্রমণ করেছিলেন যেখানে কুমিরের তেল ও বিভিন্ন ভেষজ ঔষধ বিক্রি করা হয়। চীনের মূল ভূখন্ডের পর্যটকদের কাছে এটি একটি জনপ্রিয় দোকান।
একজন বিক্রয়কর্মী ঐ দলটিকে তাদের দোকানের জিনিসপত্র দেখান। এমনকি তাদের হাতে ঔষধি তেলও মালিশ করে দেন।
ঐ চীনা দলটি তাদের ভ্রমণ শেষ করে চীনে ফেরত যায়, তবে ফেলে রেখে যায় অদৃশ্য কিছু জিনিস। ...
ঐ সময়ে সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছিল ১৮ জনের মধ্যে, যেগুলোর সবগুলোই চীনের মূল ভূখন্ড থেকে আসা মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখ সিঙ্গাপুরের সরকার জানায় যে স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেও ভাইরাস ছড়িয়েছে, যার প্রথম গুচ্ছটি ইয়ং থাই হ্যাং চাইনিজ ঔষধের দোকানে ছিল। প্রথম দুইজন অসুস্থ হওয়া ব্যক্তি ছিলেন স্থানীয় একজন ট্যুর গাইড ও একজন বিক্রয়কর্মী।
ঐ একটি দোকান থেকে নয় জন সংক্রমিত হয়, যার মধ্যে বিক্রয়কর্মীর স্বামী, তার ছয় মাস বয়সী সন্তান এবং তাদের ইন্দোনেশিয়ান গৃহকর্মী ছিলেন। ঐ দোকানের আরো দু'জন কর্মীর মধ্যেও ভাইরাস ছড়ায়।
তাদের সবাই এখন সুস্থ আছেন। তবে পরিস্থিতি আরো অনেক ভয়াবহ হতে পারতো যদি সিঙ্গাপুরের কার্যকর কন্টাক্ট ট্রেসিং বা সংস্পর্শের ইতিহাস নির্ণয় করার পদ্ধতি না থাকতো। ভাইরাসটি একজন থেকে কীভাবে আরেকজনের মধ্যে সংক্রমিত হয় তা নির্ণয় করা, ঐ ব্যক্তিদের শনাক্ত করা, তাদের এবং ভাইরাস ছড়ানোর আগে তাদের সংস্পর্শে আসা সবাইকে কার্যকর ভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয় এই পদ্ধতিতে।
মাউন্ট এলিজাবেথ নভেনা হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এভং সিঙ্গাপুর সরকারের উপদেষ্টা লেয়ং হো নাম মন্তব্য করেন, "আমাদের অবস্থা উহানের মত হয়ে যেত। হাসপাতালগুলো উপচে পড়তো।"
১৬ই মার্চ পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে ২৪৩ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত করা গেছে যার মধ্যে একজনেরও মৃত্যু হয়নি। সংক্রমিতদের প্রায় ৪০% মানুষের মধ্যে কোনো উপসর্গ দেখা যাওয়ার আগেই স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয় পরীক্ষা করতে এবং নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে।
১৬ই মার্চ পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে মোট ৪ হাজার মানুষ ভাইরাস আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে এসেছিল বলে নিশ্চিত করা গেছে। সিসিটিভি ফুটেজ, পুলিশের তদন্ত এবং পুরনো ধাঁচের গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে এই মানুষগুলোকে শনাক্ত করা গেছে, অনেক সময়ই যার শুরু হয়েছে একটি টেলিফোনের মাধ্যমে। ...
ধাঁধাঁর উত্তরের খোঁজে গোয়েন্দারা
সিঙ্গাপুরের যেই কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করা হয়, তার একটি সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে। ঐ হাসপাতালের যে তিনজন কন্টাক্ট ট্রেসিং করেন বা ভাইরাস সংক্রমিতদের সংস্পর্শে আসতে পারেন এমন মানুষদের খুঁজে বের করেন, কনসেসাও এডউইন ফিলিপ তাদের মধ্যে একজন।
হাসপাতালে আসা করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীরা কাদের সংস্পর্শে এসেছেন এবং কোথায় কোথায় গিয়েছেন, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে তার দল। তিনি জানান, "আমরা যখন পরীক্ষার পর কাউকে পজিটিভ পাই তখন সব কাজ বাদ দিয়ে রাত ৩টা পর্যন্ত তার সাথে কথা বলি। পরেরদিন সকালে আবারো সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়।"
ঐ তথ্য তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করে, এরপর পদক্ষেপ নেয়া হয় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
এডউইন ফিলিপ বলেন, "প্রথম তথ্যটি ছাড়া বাকিগুলোর যোগসূত্র মেলানো সম্ভব না। এটি অনেকটা ধাঁধাঁর মত, সবগুলো টুকরো আপনাকে মেলাতে হবে।"
ঐ কাজের জন্য নিয়োজিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যেসব দল কাজ করে, সেরকম একটি দলের নেতৃত্ব দেন জুবাইদা সাইদ। তথ্য একত্রিত করার ক্ষেত্রে অনেকসময়ই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় তার দল। অনেক সময়ই আক্রান্তরা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মত শারীরিক অবস্থায় থাকেন না যা তাদের কাজকে আরো কঠিন করে তোলে।
তখন শুরু হয় তৃতীয় ধাপের কাজ। এ ধরণের কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের সহায়তাও নেয় সিঙ্গাপুর। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার লিয়াম ঘিম হুয়া ইমেইল করে বিবিসিকে জানান, "তথ্য আদান প্রদানের জন্য পুলিশ ও মন্ত্রণালয় নিয়মিত টেলি-কনফারেন্স করে।"
"গড়ে ৩০ থেকে ৫০ জন অফিসার প্রতিদিন কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের জন্য নিয়োজিত থাকেন। কোনো কোনো দিন এই দায়িত্বে ১০০ জন অফিসারও থাকেন।" পুলিশ তাদের নিয়মিত দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশিই এই কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের কাজ করে থাকে। সিঙ্গাপুরের অপরাধের হার কম থাকার কারণে একসাথে দুই দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ বিভাগ। এই কাজে তদন্ত বিভাগ কখনো কখনো মাদক বিভাগ ও গোয়েন্দা বিভাগেরও সহায়তা নিয়ে থাকে। সিসিটিভি ফুটেজ, তথ্য চিত্রায়ন এবং তদন্তের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে অচেনা কন্টাক্টদের শনাক্ত করা হয়।
এই পদ্ধতির কার্যকারিতা জুলির ঘটনা দিয়েই বোঝা যায়। ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে জ্বর জ্বর ভাব নিয়ে হাসপাতালে যান তিনি। জুলি ভাইরাস সংক্রমিত হয়েছেন, এই তথ্য চিকিৎসকরা তাকে জানানোর এক ঘণ্টার মধ্যেই কর্মকর্তারা কাজ করা শুরু করে দেয় কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের। "হাসপাতালের বিছানায় থাকার সময়ই আমি প্রথম ফোনটি পাই", বলেন জুলি। এরপর শুরু হয় আগের সাতদিন তিনি কোথায় কোথায় গিয়েছেন এবং কার কার সংস্পর্শে এসেছেন সে বিষয়ে বিস্তারিত প্রশ্ন।
"আমি কার সাথে ছিলাম, কী করছিলাম সেগুলো সহ যাদের সাথে ছিলাম তাদের সাথে যোগাযোগের পন্থাও তারা জানতে চায় আমার কাছে।" কর্মকর্তারা বিশেষ করে জানতে চাইতেন ২ মিটার দূরত্বে অন্তত ৩০ মিনিট ধরে কার কার সাথে তিনি সময় যাপন করেছেন। "কারো সাথে যদি আমার ধাক্কা লেগে যায় সেবিষয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। যাদের সাথে কিছুক্ষণ সময় পার করেছি, তাদের বিষয়ে জানতে চাইছিল তারা।"
জুলি কন্টাক্ট ট্রেস করা কর্মকর্তার সাথে প্রায় তিন ঘন্টা ধরে কথা বলেন। ফোন রাখার পর দেখা যায় তিনি ৫০ জনকে শনাক্ত করেছেন যাদের সবার সাথে যোগাযোগ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং প্রত্যেককে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনের আদেশ দেয়া হয়। ঐ ৫০ জনের একজনের মধ্যেও ভাইরাস সংক্রমণ ঘটেনি।' [https://www.bbc.com/bengali/news-51977095]
এই প্রতিবেদনে বলা হয়, '১৬ই মার্চ পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে মোট ৪ হাজার মানুষ ভাইরাস আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে এসেছিল বলে নিশ্চিত করা গেছে।' ওই ৪ হাজার মানুষের খোঁজ নিলে এখন দেখা যাবে, এদের ১০০ জনও পরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি।
(পাঁচ) 'জাপানের করোনা মোকাবিলার সফল মডেল 'টিটিটি'' শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় ডেইলী স্টার বাংলায় ১৬ মে ২০২০ তারিখে, লিখেন ড. আশির আহমেদ, সহযোগী অধ্যাপক, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সেখানে উল্লেখ করা হয়, 'গত ১৪ মে জাপানের ৪৭টি অঞ্চলের (জেলা) মধ্যে ৩৯টি থেকে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হয়েছে। বাকি আটটির জন্য লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারলে এই শহরগুলোও জরুরি অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে। যে বেগে করোনা উধাও হচ্ছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২১ মে'র মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ধাপে ধাপে শুরু করতে পারবে জাপান। ...
আমাদের ফুকুওকা শহরে প্রথম যিনি করোনা আক্রান্ত হন, তার হিস্ট্রি থেকে জানা গেল, তিনি কখনো বিদেশে যাননি। এমনকি এরমধ্যে টোকিওতেও যাননি। চিন্তার বিষয়। তার করোনা এলো কোথা থেকে? নিশ্চয়ই আরও আক্রান্ত আছে অথবা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে। একজন মহামারি বিশেষজ্ঞ জানালেন, একজন শনাক্ত হওয়া মানে হলো— সে ইতোমধ্যে আরও ৫০ জনকে সংক্রমিত করতে করতে হাসপাতালে এসেছে। তাই টেস্ট সংখ্যা বাড়ানো উচিত। তবে, উপসর্গ দেখা গেলে তারপর টেস্ট। ...
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একজনের করোনা শনাক্ত হলো ১৭ মার্চ। কোনোরকম গুজব ছড়ানোর আগে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রেস রিলিজ দিলেন। প্রেস রিলিজের ভাষা খুব সহজ। রোগীর ব্যক্তিগত কোনো তথ্য যেন প্রকাশ না পায়, তার ওপর আলাদা গুরুত্ব দিলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন একজন মুখপাত্র। জ্বী, একজন। যাতে সংবাদে কোনো ধরনের ভুল অথবা অসামঞ্জস্য না থাকে।
আক্রান্ত ব্যক্তি একজন বিদেশি ছাত্রী। নাম বলা নেই। দেশের নাম বলা নেই। মেয়েটি একটি স্টাডি ট্যুরে ইউরোপে গিয়েছিলেন। সঙ্গে দুই জন শিক্ষক ও তিন জন সহপাঠী ছিলেন। প্রেস রিলিজে উল্লেখ করা হলো, আক্রান্ত ব্যক্তির বয়স ৩০'র ঘরে, বিদেশি, ছাত্রী। ৩ মার্চ ইউরোপে স্টাডি ট্যুরে গিয়ে ৯ মার্চ ফুকুওকাতে ফিরে আসে। ১০ মার্চ জ্বর-জ্বর ভাব। ১৬ মার্চ পিসিআর টেস্ট। ১৭ মার্চ ফলাফলে করোনা পজিটিভ।
টেস্টের পর শুরু হল ট্রেস। সহযাত্রী সবার সঙ্গে যোযাযোগ করা হলো। একজন দেশের বাইরে। বাকি সবাইকে বাসা থেকে বের না হবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ সদর দপ্তর (এখানে লক্ষ্য করুন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অলরেডি নির্বাচন কমিশনের মতো সদর দফতর তৈরি করা হয়েছে) ফুকুওকা সিটি অফিসের সঙ্গে কাজ করবে। এই রোগ যেন আর সংক্রমিত না হতে পারে, তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
মেয়েটি যে প্রোগ্রামে ইউরোপে গিয়েছিল, সেই প্রোগ্রামের ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে আমি কিছুটা জড়িত। ১৭ মার্চ রাত দেড়টা পর্যন্ত মেইল চালাচালি হলো। ১৮ মার্চ সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে পরবর্তী স্টেপগুলো নির্ধারিত হলো। সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কর্তৃপক্ষকে পরবর্তী স্টেপগুলো নিয়ে নির্দেশনামা পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এই হলো ইমারজেন্সি সিচুয়েশনে জাপানি কাজের স্পিড।
কীভাবে এই স্পিড আর নিখুঁত সিদ্ধান্ত সম্ভব?
সোজা। 'ভূমিকম্প' আসলে কী করতে হবে, মহামারি আসলে কী করতে হবে, এসব গাইডলাইন আগেই তৈরি করা আছে। কনসেপ্ট টেস্টিং অ্যান্ড প্রুফ করা। 'আগে আসুক তারপর দেখা যাবে', এমন রীতি ৭০ বছর আগেই জাপান বিদায় করেছে।
সংক্রামক ব্যাধি তো এটা প্রথম নয়। করোনাও প্রথম নয়। সার্স (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম), মার্স (মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) সবই তো করোনা। তবে, এবারের নভেল করোনার স্পিড আলাদা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বিভাগ আছে, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট। তাদের ওয়েবসাইটে করোনা নিয়ে শিক্ষার্থী ও স্টাফদের নির্দেশাবলী দেওয়া আছে। 'কী ঘটলে কী করতে হবে', তা সুন্দর ডায়াগ্রাম দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনো উপসর্গ দেখা দিলে একটি হটলাইনে ফোন করতে হবে। হটলাইন ২৪ ঘণ্টা খোলা। ১৮টি ভাষায় কথা বলা যাবে। কারণ, এখানে বিদেশিরাও থাকেন, যারা জাপানি বলতে পারেন না। তাদের জন্য এই ব্যবস্থা। এটা ফুকুওকা সিটি অফিস মেইন্টেইন করে। জাপানের ৪৭টি জেলার মোটামুটি সব জেলাতেই হটলাইনের ব্যবস্থা করা।
রোগীর সহযাত্রীদের নিয়ে পিসিআর টেস্ট করতে গেলাম। জাপানে সবাই পিসিআর টেস্ট করার জন্য যোগ্য নন। রোগীর সহযাত্রী টেস্টের যোগ্য। তার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলাম ১৮ মার্চ বিকালে।
হাসপাতালে গেলাম গাড়ি নিয়ে। আমাদের গাড়িতে অপেক্ষা করতে বলা হলো। দুই জন নার্স এলেন। ফকফকে সাদা পোশাক পরা। আমি ভেবেছিলাম হয়তো মহাকাশযাত্রীদের মতো ড্রেস পরে আসবেন। একেবারেই স্বাভাবিক ড্রেস। শুধু মুখমন্ডল একটা স্বচ্ছ প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা। অনেকটা বিয়ের পাগড়ি যে ধরনের বাক্সের মধ্যে থাকে, তার শুধু প্লাস্টিক অংশটার মতো। আমার মনে হয় রোগী যেন আতঙ্কিত না হয়, এর জন্য তারা সাধারণ, কিন্তু সুরক্ষিত পোশাক ব্যবহার করছেন।
ভেতরে গেলাম। সাধারণ একটি রুম। রুমে ঢোকার আগে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে দিলেন।
একটা লম্বা কটনবাডের মতো নল নাকে ঢুকিয়ে নমুনা সংগ্রহ করলেন। তিন মিনিটের কাজ। পরদিন বেলা ২টায় ফলাফল এলো। সহযাত্রী সবাই নেগেটিভ। তবে, দুই সপ্তাহ কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। ...' [https://www.thedailystar.net/bangla/150730]
(ছয়) 'ব্রিটেনে করোনায় বাংলাদেশীর মৃত্যু' শিরোনাম দৈনিক নয়াদিগন্তে ১০ মার্চ ২০২০ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, 'ব্রিটেনে রোববার যে তৃতীয় ব্যক্তি করোনাভাইরাসে মারা গেছেন, তিনি ব্রিটিশ-বাংলাদেশী। সংক্রমণ ধরা পড়ার মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় ম্যানচেস্টারের এক হাসপাতালে তিনি মারা যান। তার ছেলে বিবিসি বাংলার মোয়াজ্জেম হোসেনের কাছে বর্ণনা করেছেন কিভাবে ইতালিতে বেড়াতে গিয়ে তার বাবা করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়েছিলেনঃ
"প্রতি বছরের শুরুতে আমার বাবা ইতালিতে বেড়াতে যান দুই-তিন সপ্তাহের জন্য। এটা তার একটা প্রিয় বেড়ানোর জায়গা। কারণ বহু বছর তিনি ইতালিতে ছিলেন। ১৯৮৯ সালে তিনি বাংলাদেশ থেকে ইতালি আসেন। তখন তিনি বয়সে তরুণ।
উত্তর ইতালির যে শহরে আমরা থাকতাম সেটা মিলান থেকে ৫০ মাইল দূরে। সেখান থেকে সুইটজারল্যান্ডের সীমান্তও বেশি দূরে নয়। বহু বছর আমরা সেখানে ছিলাম। আমার জন্ম সেখানেই। বড় হয়েছি সেখানে।
পাঁচ-ছয় বছর আগে আমরা পাকাপাকিভাবে ব্রিটেনে চলে আসি। আমরা থাকি ম্যানচেস্টারের কাছে। কিন্তু আমার বাবা ইতালিতে বেড়াতে যেতে পছন্দ করতেন। আমরাও প্রতি বছর গ্রীষ্মে পরিবারের সবাই মিলে সেখানে বেড়াতে যেতাম। তবে বাবা প্রতি বছরের শুরুতে নিয়ম করে বেড়াতে যেতেন ইতালিতে তার পুরোনো শহরে । এ বছরও গিয়েছিলেন।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি তিনি সেখানে যান। তখনও ইটালিতে করোনাভাইরাস এত ব্যাপকভাবে ছড়ানোর কথা শোনা যায়নি। কিন্তু তিনি যে দুই সপ্তাহ ইতালিতে ছিলেন, তার মধ্যেই পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হয়। ব্যাপকভাবে সেখানে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখ বাবা ফিরে আসলেন ইতালি থেকে। তখনও তিনি সুস্থ। কিন্তু তিন দিন পর সব যেন ওলট-পালট হয়ে গেল।
মার্চের তিন তারিখ, মঙ্গলবার। সেই মঙ্গলবারটা ছিল আর যেকোনো দিনের মতোই। আমাদের বাড়ির কাছে যে হেলথ সেন্টার, বাবা সেখানে গিয়েছিলেন ডাক্তার দেখাতে। এই অ্যাপয়েন্টমেন্টটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল।
বাবার বয়স ছিল ৬০ বছর। তার নানা ধরনের অসুস্থতা ছিল, যা নিয়ে তিনি বেশ ভুগছিলেন। কোলেস্টরেল, আর্থ্রাইটিস, হৃদরোগ, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট। তবে এসবের পরও তিনি মোটামুটি ভালোই ছিলেন। তিনি এক শ' ভাগ সুস্থ ছিলেন, এটা বলা যাবে না, কিন্তু মোটামুটি ভালো ছিলেন।
করোনা ভাইরাস নিয়ে যেহেতু আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল, তাই আমি কিছু মাস্ক কিনেছিলাম। আমি আমার মা-বাবাকে বললাম, বাইরে যাওয়ার সময় যেন তারা মাস্ক পরে বের হন।
গত মঙ্গলবার বাড়ির কাছের হেলথ সেন্টারে যখন বাবা গেলেন, তখন ডাক্তার ও নার্সরা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন তিনি মাস্ক পরে আছেন। তিনি বললেন, মাত্র দুদিন আগে তিনি ইতালি থেকে এসেছেন।
সাথে সাথে সেখানে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। তাকে আলাদা করে ফেলা হলো। নর্থ ম্যানচেষ্টার জেনারেল হাসপাতাল থেকে একটা জরুরি দল চলে এলো। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।
তার সঙ্গে আমাদের সেদিনই শেষ দেখা। আমরা বুঝতে পারিনি যে আর কোনো দিন তার সঙ্গে আর দেখা হবে না।
হাসপাতালে প্রথম কয়েক দিন তিনি বেশ ভালোই ছিলেন। কিন্তু তারপর ডাক্তাররা বলছিলেন, তার রক্তে যথেষ্ট অক্সিজেন যাচ্ছে না। তার হার্টবিট অনিয়মিত। এভাবেই চলছিল কয়েকদিন। তারপর রোববার তিনি মারা গেলেন।
এদিকে বাড়িতে আমাদেরও রীতিমত আলাদা করে রাখা হয়েছিল। আমরা ঘর থেকে বেরুতে পারছিলাম না। কোথাও যেতে পারছিলাম না। বাবার খবরাখবর আমরা পেতাম টেলিফোনে।
যে ওয়ার্ডে তাকে রাখা হয়েছিল, সেখানে আমরা ফোন করতাম। সেখান থেকেই আমরা খবর পেতাম। আমরা তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারতাম না।
রোববার সকালে হাসপাতাল থেকে ফোন এলো আমাদের কাছে। তারা বললো, আধ ঘন্টা আগে বাবা মারা গেছেন। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। খবরটা শুনে ধাতস্থ হতে আমার কয়েক ঘন্টা সময় লেগেছিল। আমার বাবাকে আমি আর কোনদিন দেখতে পাবো না!
এরকম একটা খবর যখন আপনি পান, সেটা বুঝতেই আপনার অনেক সময় লেগে যায়। আমি ছিলাম শোকাহত। আমাদের বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেল।
বাবার মৃত্যুর খবর পেলেও আমরা কিছুই করতে পারছি না, কোথাও যেতে পারছি না। কারণ আমাদের সবাইকে 'আইসোলেশনে' রাখা হয়েছে। প্রতিদিন পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড থেকে আমাদের সবার কাছে টেক্সট আসে। তারা জানতে চায়, আমাদের সব ঠিক আছে কীনা। আমাদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কোন লক্ষণ আছে কীনা। প্রতিদিন আমাদের সেই টেক্সটের জবাব দিতে হয়। এখন পর্যন্ত আমরা সবাই ভালো আছি। আমাদের কারো মধ্যে করোনাভাইরাসের কোন লক্ষণ নেই।
আমরা এক সপ্তাহ এই অবস্থায় আছি। আরো এক সপ্তাহ থাকতে হবে।' [https://www.dailynayadiganta.com/uk/486957]
(সাত) 'চীনের সেই দিনগুলো' শিরোনামে ইউএন নিউজ, বেজিং সূত্রে প্রথম আলোয় ২০ মার্চ ২০২০ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ''করোনাভাইরাসের সংক্রমণে চীনে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা এখন কমে এলেও এর সঙ্গে জড়িত মানসিক যাতনার কথা সুস্থ হয়ে ফেরা ব্যক্তিদের মুখে উঠে আসছে। এমনই একজন ইউএন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (ইউএনডিপি) চীনের অফিসে কর্মরত এক ইন্টার্নি। এই তরুণী বলেছেন, করোনাভাইরাসে সংক্রমিত সন্দেহে কয়েক দিন তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হয়, যা ছিল তাঁর জন্য অত্যন্ত আতঙ্কের কয়েকটি দিন।
এই তরুণী বলেন, ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর কাছে একটি ফোন আসে। তাঁকে জানানো হয়, তাঁর এক বন্ধুর কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছে। ওই বন্ধু কয়েকদিন আগেই তাঁর বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। এখন তাঁকেও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। ফোনের পাশ থেকে আসা কন্ঠস্বর জানায়, এই তরুণী ও তাঁর পরিবারকে হাসপাতালে কোয়ারেন্টিন থাকতে হবে এবং স্বাস্থ্যকর্মী না আসা পর্যন্ত তাঁদের বাড়িতেই থাকতে বলা হয়। বাড়িতে এসেই এক স্বাস্থ্যকর্মী এই ইন্টার্নির পুরো বাড়ি জীবাণুমুক্ত করেন। আরও দুজন স্বাস্থ্যকর্মী তাঁর ও তাঁর মা-বাবার স্বাস্থ্যগত তথ্যাবলী নেন এবং সম্প্রতি ভ্রমণে যাওয়া এলাকাগুলো চিহ্নিত করেন। এর পাশাপাশি এই তরুণীর বন্ধু বাড়িতে আসার পর তাঁরা যাঁদের সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁদের তালিকাও করেন।
পরে হাসপাতালে যাওয়ার পর এই ইন্টার্নির পরিবারের তিনজনেরই সিটি স্ক্যানে কোনো অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েনি। প্রথম নিউক্লিক অ্যাসিড পরীক্ষাতেও তাঁদের সংক্রমণ শনাক্ত হয়নি। এরপর তাঁর মা-বাবাকে বাড়ি যেতে দেওয়া হয়। কিন্তু এই তরুণীর সামান্য জ্বর থাকায় তাঁকে হাসপাতালেই রেখে দেওয়া হয়। ওই সময়ের কথা স্মরণ করতে গিয়ে এই তরুণী বলেন, 'আমি যদি বলি, তখন আমি আতঙ্কগ্রস্ত হইনি, তা হবে মিথ্যা। তখন আমি প্রচুর পানি খেয়েছি। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। চিকিৎসক আমার নমুনা নেন ও আরেকবার আমার ফুসফুসের পরীক্ষা করেন। দুটি পরীক্ষার ফলই ভালো এসেছিল। কিন্তু আমার জ্বর তিন দিন ছিল। তখন আমার মনে হচ্ছিল, জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাচ্ছি আমি। তখন আমি এই ভাইরাসে মৃত্যুহারজনিত খবরগুলো এড়িয়ে চলছিলাম।'
এত কিছুর পরও ভালো কিছুও যে সে সময়ে হয়েছিল, সে কথা বলতে গিয়ে এই তরুনী বলেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর বাবা তড়িঘড়ি করে নিজের ব্যাংক কার্ড ও পরিবারের বীমার কাগজপত্র নিয়ে বেরিয়েছিলেন, যদিও এর কিছুই ব্যবহার করতে হয়নি। কারণ, সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মাস্ক এমনকি খাবারও বিনা মূল্যে দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকেরা আশ্বস্ত করে জানান, সংক্রমিত হলেও সব ব্যয়ভারই রাষ্ট্র বহন করবে।''
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সংস্পর্শে এসেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত না হবার এরকম আরো আরো উদাহরণ থাকতে পারে। কিন্তু সেগুলোর প্রতি লক্ষ না করে যে উদাহরণগুলো থেকে মনে হয় করোনাভাইরাস ছোঁয়াচে, সেগুলো ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে, হচ্ছে; বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়ানোর পেছনে সেগুলোও দায়ী। কিন্তু কিভাবে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটলো, যেগুলো দেখে মনে হয় বা বিশ্বাস হয়, করোনাভাইরাস ছোঁয়াচে?
এই প্রশ্নের উত্তর জটিল। যখন প্রমাণিত হলো করোনাভাইরাস ছোঁয়াচে নয়, তখন যারা প্রথম থেকে একে ছোঁয়াচে বলে প্রচার করে জটিলতা সৃষ্টি করেছে, তাদের নিকট এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া উচিত। তবু এই নিবন্ধের পক্ষ থেকে একটু চেষ্টা করে দেখা যাক, সত্যিই কেন অনেক ঘটনা দেখে মনে হয়েছে করোনাভাইরাস ছোঁয়াচে?
আমরা উহানে যাই। সেখানে অনেক ঘটনায় দেখা গেছে, একই সাথে কয়েকজন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। গুচ্ছ গুচ্ছ ভাবে। এরকম ঘটনা ঘটার পর যখন দেখা গেছে কোনো গুচ্ছ ঘটনায় একজন প্রথমে আক্রান্ত হয়েছে, পরে অন্যরা, তখন সবাই ভাবতে শুরু করলো, প্রথমে আক্রান্ত ঐ লোক থেকেই পরে আক্রান্তরা আক্রান্ত হয়েছে, তাই রোগটি ছোঁয়াচে। কিন্তু এটা ভাবলো না, প্রথমে যে লোক আক্রান্ত হয়েছে, সে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কারণে আক্রান্ত হয়েছে। পরে আক্রান্তরাও সেই কারণেই আক্রান্ত হতে পারে। সবাই তো আর সেই কারণে একই সাথে একই দিনে আক্রান্ত হবে না। কেউ আগে, কেউ পরে আক্রান্ত হতেই পারে। কিন্তু মানুষ প্রথমে আক্রান্ত লোকের আক্রান্ত হবার কারণ না খুঁজে বা খুঁজে না পেয়ে পরে আক্রান্তদের কারণ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে যাবার কারণেই এই বিভ্রান্তি। মানুষ সহজে এটা ভেবে নেয়, পরে আক্রান্তরা প্রথমে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে আক্রান্ত হতে পারে, কারণ পৃথিবীতে অনেক অনেক রোগ আছে ছোঁয়াচে বা বায়ুবাহিত, এই রোগটিও বায়ুবাহিত বা ছোঁয়াচে হতে পারে।
উহানের মতোই সারাবিশ্বে ছোঁয়াচে হবার মাপকাঠি নির্ণয় করা হয়েছে এরকম ঘটনাগুলোকে। যদি পৃথিবীতে ছোঁয়াচে বা বায়ুবাহিত রোগের ধারণা প্রতিষ্ঠিত না থাকতো; জীবাণু, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াকে মানুষ রোগ সৃষ্টি বা ছড়ানোর ক্ষমতা না দিতো, তাহলে উহানের মতো কোনো ঘটনা থেকে মানুষ ছোঁয়াচে হবার ঘ্রাণ খুঁজে পেতো না কোনোভাবে। মানুষ আরো আগেই উহানের ঘটনার রহস্য খুঁজে বের করতে পারতো। মাছের বাজারের সাথে উহানের প্রাদুর্ভাবের সম্পর্ক সৃষ্টি করার সুযোগ পেতো না কেউ, এমনকি কোনো দুষ্কৃতিকারী অন্য দেশে উহানের পর পরই উহানের মতো একই মহামারী সৃষ্টি করার সুযোগ বা সাহস পেতো না।