করোনাভাইরাসের প্রকৃত রহস্য
[করোনাভাইরাস : কোত্থেকে ছড়ালো? সত্যিই কি ছোঁয়াচে? সত্যিই কি কোনো ‘ভাইরাস’? মহামারী প্রতিরোধে করণীয়]
আণবিক বোমা তৈরি ও প্রয়োগের উদ্দেশ্য সম্পর্কে দু'টি নিবন্ধ দেখা যাক
দৈনিক কালের কন্ঠে ৯ আগস্ট, ২০১৫ তারিখে 'ফিরে দেখা : হিরোশিমা-নাগাসাকির ভয়ংকর অভিজ্ঞতা' শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন বিশিষ্ট কলামিস্ট হায়দার আকবর খান রনো। নিবন্ধটির একটা বড় অংশ উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি লিখেন, 'ঠিক ৭০ বছর আগে ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের দুই শহরে অ্যাটম বোমা নিক্ষেপ করেছিল। ৬ আগস্ট হিরোশিমা শহরে এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকি শহরে। এটি ছিল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য, সবচেয়ে নৃশংস ও সবচেয়ে বর্বর ঘটনা। তাৎক্ষণিকভাবে মারা গিয়েছিল দুটি শহরের মোট ছয় লাখ ২০ হাজার জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি- তিন লাখ ৪০ হাজার মানুষ। মানবতার বিরুদ্ধে এত বড় অপরাধ আর কখনো সংঘটিত হয়নি। মহাত্মা গান্ধী এই অ্যাটম বোমা নিক্ষেপের ঘটনাকে 'বিজ্ঞানের সবচেয়ে শয়তানিপূর্ণ ব্যবহার' বলে অভিহিত করেছিলেন। মার্কিন প্রশাসন আজ পর্যন্ত এই জঘন্য অপরাধের জন্য ক্ষমা চায়নি। এমনকি এটা যে অপরাধ ছিল সে কথাও বলেনি। সেই মার্কিন প্রশাসন যখন গণতন্ত্র ও মানবতার কথা বলে, তখন তা পরিহাস বলেই মনে হয়।
পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধক্ষেত্রে দুইবার মাত্র অ্যাটম বোমা ব্যবহৃত হয়েছে এবং তা করেছে একমাত্র একটি রাষ্ট্র- যুক্তরাষ্ট্র। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রই হচ্ছে একমাত্র দাগি আসামি। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র দেশ, যা এর পরও ২৮ বার পারমাণবিক বোমা প্রয়োগের হুমকি দিয়েছিল। তাহলে বিশ্বশান্তি নিশ্চিত করতে হলে প্রথমেই দরকার হবে দাগি আসামিকে নিরস্ত্র করা। কিন্তু আমরা দেখছি উল্টো ব্যাপার। অ্যাটম বোমা ব্যবহারকারী আমেরিকাসহ বড় শক্তিগুলোর হাতে পারমাণবিক বোমা থাকলে বিশ্ব সংস্থার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের কোনো ছোট দেশ এই বোমা রাখতে পারবে না। দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে এক হাজারের বেশি আণবিক অস্ত্র আছে, যার সব কয়টিই উত্তরের দিকে তাক করা। এতে জাতিসংঘ নির্বিকার রয়েছে। কিন্তু যখন উত্তর কোরিয়া আত্মরক্ষার্থে পারমাণবিক বোমা বানায়, তখনই তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। বিভিন্ন সূত্র থেকে এটা নিশ্চিত যে ইসরায়েলের আছে দুই শতাধিক পারমাণবিক বোমা। পাশ্চাত্যের শক্তিগুলো এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। কিন্তু ইরান যখন শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের জন্য পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণ করে, তখন মার্কিন প্রশাসন আপত্তি করে বসে। তার সঙ্গে যোগ দেয় বড় শক্তিগুলো। ইরাকের কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র আছে- এই মিথ্যা অভিযোগে জাতিসংঘের আপত্তিকে গ্রাহ্য না করেই মার্কিন ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ দেশটি দখল করেছিল। এত বড় যুদ্ধাপরাধের জন্য ব্লেয়ার-বুশের শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হয়নি। কারণ এখনো বিশ্বে গায়ের জোরই মূল কথা।
হিরোশিমা-নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা ফেলে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ কেবল তাৎক্ষণিকভাবেই সাড়ে তিন লাখ মানুষ মারেনি। পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে পরবর্তী সময়ে প্রায় সমসংখ্যক মানুষ মারা গেছে অথবা গুরুতর অসুস্থ হয়েছে। পরবর্তী এক দশকে জাপানে তেজস্ক্রিয়তার কারণে বহু বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিয়েছিল। আমেরিকায় অবস্থানরত বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছিলেন, কত ভয়ানক হতে পারে অ্যাটম বোমার ফলাফল। তাঁরা মার্কিন প্রশাসনকে এই ভয়ংকর বোমা ব্যবহার করতে আপত্তি জানিয়েছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান প্রশাসন তাঁদের কথা শোনেনি।
এ কথা ঠিক যে, যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেওয়া হাঙ্গেরীয় বিজ্ঞানী লিয়ো জিলার্ডের অনুরোধে মহান বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে অ্যাটম বোমা প্রকল্পের জন্য চিঠি লিখেছিলেন। ১৯৩৯ সালের ২ আগস্ট। পরবর্তী সময়ে তিনি এ জন্য অনুতপ্ত হয়েছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিল, সম্ভবত হিটলারের জার্মানি এই ভয়ংকর অস্ত্রটি আবিষ্কার করে ফেলেছে। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করে। তার পরই অ্যাটম বোমার প্রকল্প হাতে নেন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র প্রথম সফল আণবিক পরীক্ষা চালিয়েছিল।
এর আগেই ১৯৪৫ সালের ৮ মে হিটলারের জার্মানির পতন হয় সোভিয়েত লালফৌজের হাতে। তারপর বিজ্ঞানী জিলার্ড, আইনস্টাইনসহ প্রায় সব বৈজ্ঞানিক মার্কিন সরকারকে অ্যাটম বোমা তৈরি করা থেকে বিরত থাকতে বলেন। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী জেমস ফ্রাংকের নেতৃত্বে মার্কিন সরকার যে কমিটি গঠন করেছিল, সেই কমিটি ১৯৪৫ সালের ১১ জুন মার্কিন প্রশাসনের যুদ্ধ সচিবের কাছে যে রিপোর্ট পেশ করেছিল তাতে এই বোমা ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি জানানো হয়েছিল। কিন্তু বিজ্ঞানীদের এই পরামর্শের কোনো মূল্য ছিল না যুদ্ধবাজ মার্কিন প্রশাসনের কাছে।
সেই সময় যুদ্ধ চলছিল। এই যুদ্ধে জাপানকে পরাজিত করার জন্য কি অ্যাটম বোমা নিক্ষেপ করাটা আসলেই প্রয়োজন ছিল? এর উত্তর যুদ্ধকালীন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের বক্তব্য থেকেই শোনা যাক। 'এটা মনে করা ভুল হবে যে অ্যাটম বোমার দ্বারা জাপানের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছিল। প্রথম বোমা নিক্ষেপের আগেই জাপানের পরাজয় নিশ্চিত হয়েছিল।' প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও ট্রুম্যানের আমলের চিফ অব স্টাফ মার্কিন সেনাপতি W. B. Leathy একই কথা বলেছেন। মার্কিন সেনাপতি ম্যাক আথরিও বলেছেন, সে সময় জাপান আত্মসমর্পণের জন্য পথ খুঁজছিল। যুদ্ধকালীন সেনাপতি ও পরবর্তী সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ারও বলেছেন যে অ্যাটম বোমা নিক্ষেপের আগেই জাপান আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। কারণটাও খুব স্বাভাবিক। ইতিপূর্বে হিটলারের পতন হয়েছে। ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। একমাত্র পূর্ব দিকে যুদ্ধ চলছে। কিন্তু জাপানের পরাজয়ও নিশ্চিত। তাহলে কেন সেদিন মার্কিন প্রশাসন জাপানে অ্যাটম বোমা নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল?
এর উত্তরও তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের কাছ থেকেই শোনা যাক। 'যুদ্ধ শেষে আমাদের শর্ত চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে (dictate our own terms) এই বোমা আমাদের সুবিধাজনক অবস্থানে এনে দিয়েছে।' হ্যাঁ, জাপানকে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে যাতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, সে জন্য দরকার ছিল সারা বিশ্বকে অ্যাটম বোমার ভয় দেখানোর। অর্থাৎ অ্যাটম বোমাকে ব্ল্যাকমেইল করার উপযুক্ত হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছিল মার্কিন প্রশাসন এবং সে জন্য লাখ লাখ মানুষ হত্যা করতে তাদের বাধেনি। সাম্রাজ্যবাদের কি কখনো নৈতিকতা বোধ থাকে?
এ ছাড়া আরো একটি বড় কারণ ছিল। তা হলো সমাজতন্ত্রের অপ্রতিরোধ্য গতিকে থামিয়ে দেওয়ার প্রয়াস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের পতন ঘটেছে সোভিয়েত লালফৌজের হাতে। পূর্ব ইউরোপে লালফৌজের জয়জয়কার। চীনের বিশাল অঞ্চলজুড়ে কমিউনিস্টদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অ্যাটম বোমার ভীতি প্রয়োগ করতে হবে। ট্রুম্যান প্রশাসনের যুদ্ধসচিব হেনরি স্টিমসনের স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ 'On Active Service'-এ অ্যাটম বোমা নিক্ষেপের ঘটনাকে "...a badly needed 'equilizer' in the diplomatic struggle with USSR" বলে অভিহিত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে অ্যাটম বোমা নিক্ষেপের তারিখটিও কিন্তু বিশেষভাবে লক্ষণীয়। একটু পেছনের ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যাক। ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মিত্রশক্তির তিন প্রধান রাষ্ট্রনায়কের শীর্ষ সম্মেলন হয়েছিল- ইয়েলটা সম্মেলন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা স্তালিন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে মাঞ্চুরিয়াতে অবস্থিত সোভিয়েত লালফৌজ জাপানে আঘাত হানবে। তারিখটিও নির্দিষ্ট হয়েছিল ৮ আগস্ট। সে অনুসারে সোভিয়েত লালফৌজ প্রস্তুতি নিয়েছিল। সমুদ্রের অপর দিকে তারা অপেক্ষা করছিল জাপানে আক্রমণ করার জন্য। এরপর জার্মানির পরাজয় হয়। ১৯৪৫ সালের ১৭ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত চলে পোটসড্যাম সম্মেলন। তাতে উপস্থিত ছিলেন স্তালিন, চার্চিল ও যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান। (কারণ এর আগেই রুজভেল্ট মারা গেছেন।) সেখানেও একই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সোভিয়েত লালফৌজ জাপান আক্রমণ করবে। আর মাত্র কয়েক দিন পর- ৮ আগস্ট।
ঠিক সেই সময়ই দুই-দুইটি শীর্ষ সম্মেলনের যৌথ সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে যুক্তরাষ্ট্র জাপানে অ্যাটম বোমা ফেলল। ৮ আগস্টের আগেই। ৬ আগস্ট। সমুদ্র পাড়ে অবস্থানরত সোভিয়েত বাহিনী স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। স্তালিন আপাতত জাপানে সৈন্য পাঠানো থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলেন। তার পরও মার্কিন প্রশাসন নিশ্চিত ছিল না। ভয় পেয়েছিল। যদি রাশিয়া পূর্ব সিদ্ধান্তমতো জাপানে পৌঁছে যায়। তাই তারা ৯ আগস্ট আরেকটি অ্যাটম বোমা ফেলল। একদিকে সম্মেলনে যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অপর দিকে সেই সিদ্ধান্তকে ভন্ডুল করার যে নোংরা কৌশল নিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন, তাও কিন্তু হঠাৎ করে হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের তদানীন্তন সেক্রেটারি অব স্টেট Byrnes-এর একটা বক্তব্য তদানীন্তন মার্কিন নৌবাহিনীর সচিব জেমস ফরেস্টালের ডায়েরি থেকেও জানা যায়। (পরে তা Forrestal Diary নামে বই আকারে ছাপা হয়েছিল)। সেখানে তিনি লিখেছেন, মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট ইুৎহবং পোটসড্যাম সম্মেলনের সময় খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন জাপানে রাশিয়ার প্রবেশের আগেই যেন জাপানের ব্যাপারটি ফয়সালা হয়। তাই জাপানে অ্যাটম বোমা নিক্ষেপের বিষয়টি ছিল সোভিয়েত অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করার পরিকল্পনারই অংশ। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী P.M.S. Blackelt অ্যাটম বোমা ফেলার তারিখটি নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন "Fear, War and the Bomb" গ্রন্থে। তিনি এটিকেই শীতল যুদ্ধের সূচনা বলে উল্লেখ করেছেন। কী ভয়ংকর 'উত্তপ্ত' ঘটনার মধ্য দিয়ে 'শীতল' যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল।
যুদ্ধের পরপর জাতিসংঘ গঠিত হয়েছিল। জাতিসংঘ আণবিক এনার্জি কমিশনের প্রথম বৈঠকেই সোভিয়েত প্রতিনিধি এন্দ্রি গ্রোমিকো সব পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন ও মজুদ রাখা নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব রাখেন। তখনো পর্যন্ত অ্যাটম বোমার একচেটিয়া অধিকারী যুক্তরাষ্ট্র তাতে রাজি হয়নি। অন্য সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোও (যথা- ব্রিটেন, ফ্রান্স, যাদের হাতে তখনো পর্যন্ত অ্যাটম বোমা ছিল না) রাজি হয়নি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনেও সোভিয়েতের এই প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পায়নি। এরপর যুক্তরাষ্ট্র আবারও অ্যাটম বোমার পরীক্ষা চালাল। এবারও জাপানে। তবে সাগরে। ১৯৪৬ সালের ১ জুলাই।
বছর তিনেকের মধ্যেই আমেরিকার মনোপলি ভেঙে দিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারাও অ্যাটম বোমা আবিষ্কার করল। ১৯৪৯ সালের ২৯ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম অ্যাটম বোমার পরীক্ষা চালাল। পঞ্চাশের দশকে ব্রিটেন ও ফ্রান্স এবং ১৯৬৪ সালে লাল চীনও অ্যাটম বোমা বানিয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন (পরে চীনও) আবার জাতিসংঘে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের প্রস্তাব তুলেছিল। এবারও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র তাতে সম্মত হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন (ও পরে চীন) ঘোষণা দিয়েছিল যে তারা কখনোই প্রথমে আণবিক বোমা ব্যবহার করবে না এবং যে দেশের এই বোমা নেই অথবা যে দেশে আণবিক ঘাঁটি নেই, সেই দেশের বিরুদ্ধেও এই বোমা ব্যবহার করবে না। সোভিয়েত ও চীন অন্যান্য আণবিক অস্ত্রধারী দেশের কাছ থেকেও অনুরূপ ঘোষণা দাবি করেছিল। না, এমন ঘোষণা বা প্রতিশ্রুতি মার্কিন, ব্রিটেন, ফ্রান্স দেয়নি। বস্তুত এ ঘটনা থেকেও পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের পার্থক্য চিহ্নিত হয়। পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ হলো শোষক, পরদেশ লুণ্ঠনকারী, মানবতার শত্রু, বিশ্বশান্তিরও শত্রু। সমাজতন্ত্র হচ্ছে শান্তি ও শোষক মুক্তির দুর্গ।
বর্তমান পৃথিবীতে সমাজতান্ত্রিক শিবির নেই। তাই কেন পারমাণবিক বোমাগুলো নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে না? যেখানে কোটি কোটি মানুষ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে, সেখানে কেন আণবিক অস্ত্রসহ যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণে এত বিপুল সম্পদের অপচয় করা হয়।
হিরোশিমা-নাগাসাকির সেই বীভৎস নারকীয় হত্যাকান্ড ও পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের মৌলিক চরিত্রকেই উন্মোচিত করছে। ইতিহাসের এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা ভুললে চলবে না।' [https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2015/08/09/254124]
'কী ছিল হিরোশিমা-নাগাসাকির মরণযজ্ঞের উদ্দেশ্য' শিরোনামে ১৯ আগস্ট ২০১৩ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকে একটি নিবন্ধ লিখেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। নিবন্ধটিরও একটি বড় অংশ উল্লেখ করা প্রয়োজন। লেখক লিখেন, '...১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমায় আণবিক বোমা ফেলা হয়েছিল। ইতিহাসবিদদের জিজ্ঞাসা হলো, এই মানব বিধ্বংসী নতুন অস্ত্র ব্যবহারের আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল কী? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ বা সেই যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার জন্য এর দরকার আদৌ ছিল কী? এর জবাবের জন্য এই বোমাবর্ষণের আগের ঘটনাবলীর দিকে প্রথমে দৃষ্টি দেয়া যাক।
১৯৪৫-এর আগস্টের কিছুদিন আগে, জুলাইয়ের শেষদিকে, আমেরিকানরা টোকিও শহরের ওপর বিধ্বংসী বোমাবর্ষণ করেছে। টোকিও ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। জাপানের সামরিক শক্তি প্রায় সম্পূর্ণরূপে চুরমার হয়ে গেছে। মে মাসে বার্লিন মুক্ত হওয়ার পর জার্মানির নাৎসি বাহিনী পরাজয় মেনে নিয়ে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছে। মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট ইতালি শেষ। ইউরোপে যুদ্ধ শেষ! পূর্ব ইউরোপের দেশে দেশে কমিউনিস্টরা সরকার প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের দুর্জয় 'রেড আর্মি' ইউরোপের রণাঙ্গন ত্যাগ করে দুর্ধর্ষ সমরনায়ক মার্শাল জুকভের নেতৃত্বে এশিয়ার যুদ্ধে যোগদানের জন্য রওনা হয়ে গেছে। জাপানের ভূ-খন্ডে যৌথ অভিযানের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। জাপানের সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য ২৬ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে আলটিমেটাম দেয়া হয়েছে। জাপানের হাই কমান্ড আত্মসমর্পণের কথা ভাবতে শুরু করেছে। ইউরোপের পর এবার এশিয়া যুদ্ধও শেষ হওয়ার একেবারে দ্বারপ্রান্তে। এসবই হলো প্রামাণ্য তথ্য।
এসব তথ্য থেকে স্পষ্ট যে, জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য কিংবা এশিয়ার যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার জন্য হিরোশিমা-নাগাসাকিতে এটম বোমা নিক্ষেপের কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল না। এই বোমা নিক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা ছিল অন্যত্র। কী সে প্রয়োজনীয়তা, কী সে কারণ, যে কারণে নিমিষে অসংখ্য মানুষের প্রাণ হরণ করার মতো মারণাস্ত্র আমেরিকা ব্যবহার করেছিল? আণবিক বোমা আবিষ্কারের বিষয়টি সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছিল। অবশ্য আগেই কিছুটা আঁচ করা গিয়েছিল যে জার্মানরা এ ধরনের বোমা তৈরির জন্য গবেষণা চালাচ্ছে। ১৯৪২ সালে আমেরিকা 'ম্যানহ্যাটন প্রজেক্ট' নামে এ বিষয়ে গবেষণা কাজ শুরু করে। অত্যন্ত সংগোপনে কাজ এগিয়ে নিয়ে ১৯৪৫ সালের প্রথমার্ধে তারা পরীক্ষার জন্য 'থিন ম্যান' নামে পরিশুদ্ধ প্লুটোনিয়াম দিয়ে তৈরি একটি আণবিক বোমা প্রস্তুত করতে ও তা পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়। একই প্রযুক্তিতে আরো বড় একটি বোমা 'ফ্যাট ম্যান' নাগাসাকিতে ব্যবহার করা হয়। তবে আগে কোনো পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ব্যতিরেকেই, পরিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম দিয়ে তৈরি ভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি ও ট্রিগারিং ব্যবস্থা সম্বলিত 'লিটল বয়' বোমাটি হিরোশিমায় নিক্ষেপ করা হয়। ...
হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত শুধু দু'টি বোমাতেই লক্ষাধিক মানুষ নিমিষে প্রাণ হারিয়েছিল। দেড় লক্ষাধিক মানুষ গুরুতর আহত হয়েছিল। কয়েকদিনের মধ্যে তাদেরও মৃত্যু হয়। বোমার তেজস্ক্রিয়তা বিকিরণের ফলে অচিরেই ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। হিরোশিমা-নাগাসাকির বীভৎসতার কথা বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারে চার সপ্তাহ পরে। আমেরিকা একথা অনেকদিন গোপন রাখে যে এটি একটি তেজস্ক্রিয় এটম বোমা ছিল। ফলে আণবিক তেজস্ক্রিয়তা থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করার সুযোগ থেকে মৃত্যুপথযাত্রীদের বঞ্চিত করা হয়েছিল। ফলে ডাক্তাররাও সঠিক ধারায় চিকিৎসা কাজ অগ্রসর করতে পারেনি। শুধু এ কারণেই মৃতের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। বোমার আঘাত ছিল বীভৎস, কিন্তু তার চেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল আমেরিকান 'নীরবতার' ফলাফল।
অস্ট্রেলিয়ার সাংবাদিক উইলফ্রেড গ্রাহাম বুর্চেট এটম বোমা নিক্ষেপের এই ঘটনার চার সপ্তাহ পর ২ সেপ্টেম্বর টোকিও থেকে হিরোশিমা পৌঁছান। পরে তিনি তার চোখে দেখা বিবরণ পত্রিকার জন্য নিউজ ডেসপ্যাচ আকারে প্রেরণ করেন। সেই ডেসপ্যাচে বুর্চেট লিখেন, 'তিরিশতম দিনে হিরোশিমায় : যারা পালাতে পেরেছিলেন তারা মরতে শুরু করেছেন।... চিকিৎসকরাও কাজ করতে করতে মারা যাচ্ছেন। বিষাক্ত গ্যাসের ভয়। মুখোশ পরে আছেন সকলেই।' তিনি আরো লিখেন, 'হিরোশিমাকে বোমা বিধ্বস্ত শহর বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, দৈত্যাকৃতির একটি রোলার যেন শহরটিকে পিষে দিয়ে গেছে।... পঁচিশ বা তিরিশ বর্গমাইল জুড়ে একটিও অট্টালিকা দাঁড়িয়ে নেই।' তার ডেসপ্যাচে বুর্চেট আরো লিখেন, 'বোমায় অক্ষত থাকা মানুষগুলো দিন কয়েক পরে অসুস্থ বোধ করতে শুরু করে ও হাসপাতালে যেতে থাকে। চিকিৎসকরা তাদের শরীরে ভিটামিন-এ ইনজেকশন দেয়। দেখা যায় যে, ইনজেকশনের জায়গায় মাংস পচতে শুরু করেছে। এমন মানুষদের একজনও বাঁচেনি। ৫ সেপ্টেম্বর বুর্চেটের ডেসপ্যাচটি 'ডেইলি এক্সপ্রেস' পত্রিকায় ছাপা হয়। সাহসী সাংবাদিক বুর্চেট নিজেই তেজস্ক্রিয় বিকিরণে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৩ সালে ক্যান্সারে মারা যান। সে বছরই তার লেখা 'শ্যাডো অফ হিরোশিমা' বইটি প্রকাশিত হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণের শেষ নেই। টার্গেটের কেন্দ্রে তাপমাত্রা বেড়ে কয়েক হাজার সেলসিয়াসে দাঁড়ায়। মানব দেহসহ সবকিছু মুহূর্তে সম্পূর্ণ 'নাই' হয়ে যায়। ভূ-পৃষ্ঠের পাথরে বা কংক্রিটে কেবল মানব-মানবীর দেহ অবয়বের একটি অস্পষ্ট ছায়াচিহ্ন থেকে যায়। চোখ ধাঁধানো আলো ও মহাপ্রলয়ঙ্করী ঝড় বয়ে যায়। ছাই-ভস্মসহ সবকিছু উড়ে যায় ঊর্ধ্বাকাশে এটম বোমার বিস্ফোরণের সিম্বল, ব্যাঙের ছাতা আকৃতির ধোঁয়ার বিশাল কুন্ডলিতে। হিরোশিমা-নাগাসাকির এই কুকীর্তির বোঝা আটষট্টি বছর পরেও বয়ে চলেছে সেখানকার সন্তান-সন্ততিরা। প্রতিটি মাকে ভয়ে ভয়ে দিন গুনতে হয়, যে সন্তানটি তার ভূমিষ্ঠ হবে সে বিকৃত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অবয়ব নিয়ে জন্মাবে না তো!
হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপের ঘটনাটি জাপানকে যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য করা হয়নি। এর আগেই জাপান পরাজয় মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল। কিন্তু ঠিক সেই সময়টিতে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে এ্যাটম বোমা নিক্ষেপ করলো কেন? কী ছিল উদ্দেশ্য? হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আমেরিকার এ্যাটম বোমা নিক্ষেপের পেছনে প্রথম উদ্দেশ্য ছিল, ইয়ালটা চুক্তি অনুসারে ইউরোপে যুদ্ধ শেষের পর সোভিয়েত রেড আর্মি যেন এশিয়ার যুদ্ধে প্রবেশ করতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। রেড আর্মি জাপানে বড় রকম অপারেশন শুরু করার আগেই আমেরিকার কাছে একতরফা জাপানি আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করা। এশিয়াকে কমিউনিজমের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার প্রয়াসের অংশ হিসেবেই আমেরিকাকে জরুরি ভিত্তিতে এটম বোমা নিক্ষেপ। কমিউনিজম বিরোধী মার্কিন এই ক্রুসেডের স্বার্থে লাখ লাখ নিরপরাধ জাপানি বেসামরিক নাগরিককে নিমিষে বলি দিতে মার্কিনীরা কুণ্ঠিত হয়নি।
হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আমেরিকা এটম বোমা ফেলেছিল দ্বিতীয়ত যে কারণে তা হলো, নতুন উদ্ভাবিত এই অস্ত্রটি বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রে প্রয়োগের একটি পরীক্ষা চালিয়ে দেখা ও দেখানো। এর পরে হাজার হাজার পারমাণবিক বোমা তৈরি ও মজুদ করা হলেও এবং অনেক বড় বড় যুদ্ধের ঘটনা ঘটলেও কোনো ক্ষেত্রেই এখনো সক্রিয়ভাবে এটম বোমা ব্যবহার করা হয়নি। এমনকি ভূ-পৃষ্ঠে আণবিক বোমার সবধরনের পরীক্ষাও বহু দশক ধরে নিষিদ্ধ রয়েছে। তাড়াহুড়ো করে আমেরিকা তার নব উদ্ভাবিত আণবিক বোমা ব্যবহার করেছিল তৃতীয় যে কারণে তা ছিল রাজনৈতিক। এ্যাটম বোমার মনোপলি তার হাতে থাকায় সেটিকে কাজে লাগিয়ে সোভিয়েত (ও বিশ্বের অন্যান্য সব দেশকে) ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করার উদ্দেশ্যটি ছিল আমেরিকার প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু সে পরিকল্পনা বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। অচিরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন আরো শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা তৈরির সক্ষমতা অর্জন করেছিল ও আমেরিকার আণবিক একাধিপত্য ভেঙ্গে দিয়েছিল। কিন্তু মানব ইতিহাসের যা ক্ষতি হওয়ার তা ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। আত্মঘাতী পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। পৃথিবীতে এখন যে পরিমাণ পারমাণবিক বোমা আছে তা বিস্ফোরিত হলে এই ভূ-মন্ডল ১৪ বার সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। সব পক্ষের হাতে এই মারণাস্ত্র থাকায় এবং বেশি বেশি করে থাকায় কেউ এটি ব্যবহার করতে সাহসী হবে না, এই ডেটারেন্ট (অর্থাৎ অপরকে নিবৃত্ত রাখা) তত্ত্বকে যুক্তি হিসেবে এক্ষেত্রে তুলে ধরার চেষ্টা হয়। ডেটারেন্ট তত্ত্বকে MAD (Mutually Assured Destruction) নীতি বলে বলা হয়ে থাকে। পৃথিবী আজ আগ্নেয়গিরির মুখে রয়েছে। সব আণবিক বোমা ধ্বংস করে ফেলাসহ পরিপূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ, তথা অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া ভূ-মন্ডল ও বিশ্ব সভ্যতাকে বিপদমুক্ত করা যাবে না। বিশ্ববাসীকে আজ বজ্র নিনাদে গর্জে উঠে বলতে হবে, '...ধ্বংস ও যুদ্ধ আর না, আর না!' [https://archive.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDhfMTlfMTNfMV80XzFfNjQ2MzM=]
আণবিক এবং হাইড্রোজেন বোমা আবিষ্কার, প্রয়োগ এবং মজুতকরণের উদ্দেশ্য মানুষের কোনো কল্যাণ করা নয়। বরং উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদে অন্ধ মানুষদের হীণ স্বার্থ উদ্ধার করা। এই সব ভয়াবহ মারণাস্ত্র আবিষ্কার, তৈরি, প্রয়োগ এবং মজুতকরণের পেছনে পৃথিবীর কোনো সাধারণ মানুষ দায়ী নয়। দায়ী হচ্ছে জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং বিজ্ঞান। এই জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং বিজ্ঞান নামগুলোর পেছনে সর্বযুগে কাজ করে কিছু মানুষ; যারা ক্ষমতাধর কিছু দেশের শাসনকার্য এবং বিজ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত মানুষেরই একটা বিশেষ শ্রেণি। এই মানুষগুলো অধিকাংশ সময় এতোই বিবেকহীনতার পরিচয় দেন, ভাবতে ভুলে যান, যুদ্ধ মূলতঃ সৈন্যে সৈন্যে সংঘটিত হয়; সামরিক শক্তির সাথে সামরিক শক্তির সংঘর্ষের নাম যুদ্ধ; সাধারণ মানুষের সাথে যুদ্ধের সরাসরি সম্পর্ক নেই; নিরীহ মানুষের সাথে সামরিক শক্তির সংঘর্ষের নাম যুদ্ধ নয়; নিরীহ মানুষের ক্ষতি করাটা যুদ্ধনীতির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। আণবিক বোমার ধারণা, আবিষ্কার, তৈরি, মজুতকরণ এবং প্রয়োগের পেছনে ন্যূনতম কোনো মহৎ উদ্দেশ্য থাকার কথা যদি কেউ বলে থাকে এবং সে নিজেকে ন্যূনতম বিবেকের অধিকারী বলেও দাবি করে, এ প্রশ্নের উত্তরে 'হ্যাঁ' বলা তার পক্ষে সম্ভব হবে না, 'আণবিক বোমা সাধারণ এবং নিরীহ জনগণ ছাড়া শুধু নির্দিষ্ট কোনো সামরিক শক্তির ওপর ব্যবহার করার কি কোনো সুযোগ আছে?'
নেই। যদি না থাকে, তাহলে আণবিক অস্ত্র তৈরির পেছনে কোন্ মহৎ লক্ষ্য কাজ করে? আণবিক বোমা মানুষের কল্যানের জন্য, নাকি ধ্বংসের জন্য?
আণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, নিউট্রন বোমা এইসব ভয়াবহ মারণাস্ত্র মানবজাতির কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণের জন্যই তৈরি করা হয়। তাহলে যারা এসব মারণাস্ত্র তৈরির পেছনে কাজ করে, তাদেরকে 'সাধারণ মানুষ' বলার কি কোনো সুযোগ থাকে? তারা 'ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ', দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ, তারা মানুষরূপী শয়তান। এরকম কিছু শয়তান সর্বযুগে মানবজাতির ক্ষতি করে এসেছে। এখনও দেশে দেশে এরকম দুষ্ট প্রকৃতির অনেক লোকের দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান তৎপরতার কথা পৃথিবীর সচেতন অনেকেই জানে। এদের সব দুষ্টকর্মের কথা কি এরা প্রকাশ করবে; কোনো অপরাধ করে কি তা সবার কাছে বলে বেড়াবে? জাপানে বোমা ফেলার পর আমেরিকাও এই কথা অনেকদিন গোপন রাখে যে, এটি একটি তেজস্ক্রিয় এটম বোমা ছিল। হিরোশিমা-নাগাসাকির বীভৎসতার কথা বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারে চার সপ্তাহ পরে। ফলে আণবিক তেজস্ক্রিয়তা থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করার সুযোগ থেকে মৃত্যুপথযাত্রীদের বঞ্চিত করা হয়েছিল। ফলে ডাক্তাররাও সঠিক ধারায় চিকিৎসা কাজ অগ্রসর করতে পারেনি। শুধু এ কারণেই মৃতের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।
উপরের সব আলোচনার উপসংহার হিসেবে এটা ধরে নেয়া যায়, উহানের বাতাসে তেজস্ক্রিয় জাতীয় কিছু একটা ছড়িয়ে পড়েছিল বলে উহানের মানুষ ব্যাপকহারে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে শুরু করে এবং মারা যেতে শুরু করে। সেটা ভাইরাস জাতীয় কিছু ছিল না বলে অন্য অনেক দেশের অসংখ্য মানুষ উহানের সাথে সম্পর্ক ছাড়া এবং কোনো করোনারোগীর সংস্পর্শ ছাড়া একই ধরনের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে শুরু করে, উহানে করোনাভাইরাসের উপদ্রবের পর, আগে নয়। এই কথা প্রমাণ করে, করোনাভাইরাস কোনো 'ভাইরাস' নয়, তেজস্ক্রিয় জাতীয় কিছু, যা উহানের বাতাসের সাথে মিশে যাবার কারণে উহানের মানুষ তীব্র ফসুফুসের সংক্রমণে ভুগতে শুরু করে, মাস্ক, পিপিই কোনো কাজে আসেনি। অসংখ্য চিকিৎসাকর্মীও, যারা এই নিউমোনিয়ার সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার সব উপায় অবলম্বনের পরও এতে আক্রান্ত হয়। ভাইরাস হলে অন্তত যারা পুরোপুরি সুরক্ষমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তারা আক্রান্ত হতো না। যদি কোনো ভাইরাস না হয়, তাহলে কিভাবে উহান এবং করোনারোগীর সাথে কোনো রকম সম্পর্ক ছাড়াই অন্য দেশের মানুষও এতে আক্রান্ত হয়, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমরা এটা খুঁজি, কেন উহানের বাতাসে তেজস্ক্রীয় কিছু মিশেছিল বলে মনে হচ্ছে এবং কোন্ ধরনের তেজস্ক্রীয় বস্তু মিশেছিল?