করোনাভাইরাসের প্রকৃত রহস্য (পর্ব-৪) : করোনাভাইরাসের কারণ নিয়ে বিভ্রান্তি

5 minute read
0
করোনাভাইরাসের প্রকৃত রহস্য
[করোনাভাইরাস : কোত্থেকে ছড়ালো? সত্যিই কি ছোঁয়াচে? সত্যিই কি কোনো ‘ভাইরাস’? মহামারী প্রতিরোধে করণীয়]

                                    তৃতীয় অধ্যায়

করোনাভাইরাসের কারণ নিয়ে বিভ্রান্তি

করোনাভাইরাসের কোনো নির্দিষ্ট কারণ এখনো কেউ খুঁজে বের করতে পারেনি। অনেক ভিন্নমত রয়েছে এই ভাইরাসের কারণ নিয়ে। সব কারণই সম্ভাব্য। এ সম্পর্কে কিছু প্রতিবেদন দেখা যাক।

'করোনাভাইরাস: লক্ষণ ও চিকিৎসা কী, কতটা মারাত্মক, কোথা থেকে এলো, কোন প্রাণী থেকে ছড়ালো, চীনে কেন?' শিরোনামে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে এ সম্পর্কে বলা হয়, 'করোনাভাইরাসের সঙ্গে সম্পর্ক আছে চীনের উহানের দক্ষিণ সমুদ্রের খাবারের পাইকারি বাজারের সঙ্গে। যদিও কিছু সামুদ্রিক প্রাণী করোনাভাইরাস বহন করতে পারে (যেমন বেলুগা, তিমি), ওই বাজারটিতে অনেক জীবন্ত প্রাণীও থাকে, যেমন মুরগি, বাদুর, খরগোশ, সাপ- এসব এসব প্রাণী করোনাভাইরাসের উৎস হতে পারে।

গবেষকরা বলছেন, চীনের হর্সশু নামের একপ্রকার বাদুরের সঙ্গে এই ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে।'


বিবিসি বাংলার এই এক প্রতিবেদনেই তিনটি সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে তিন রকম মন্তব্য উল্লেখ করা হয়ছে। প্রথমে বলা হয়েছে 'সম্পর্ক আছে', এরপর বলা হয়েছে 'হতে পারে' এবং শেষে বলা হয়েছে 'ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে'। মানে, কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়।
'বাদুড়-সাপ থেকে ছড়াতে পারে করোনাভাইরাস' শিরোনামে একটি  প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দৈনিক যুগান্তরে ২৮ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে। সেখানে বলা হয়, 'বাদুড়ের স্যুপ থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বলে দাবি করেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, কেবল ফ্রুটব্যাট বা মেগাব্যাটের মধ্যে পাওয়া ভাইরাসের সঙ্গে চীনের উহানে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসের মিল রয়েছে। বাদুড়ের স্যুপ উহানে খুবই জনপ্রিয় খাবার। এই শহরেই একটি মাছ বাজার থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। আরেকটি গবেষণায় বলা হচ্ছে, সাপ থেকেই এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে।'

প্রতিবদেনটিতে আরো বলা হয়, 'পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দাবি করছেন, বাদুড় থেকে ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশ করেছে সাপের মাধ্যমে। উহানের হুয়ানান সিফুড মার্কেটে অন্যান্য বন্যপ্রাণীর সঙ্গে সাপও বিক্রি করা হয়। আর সেখান থেকেই এই ভাইরাস মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ার আগে অন্য কোনো প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করে থাকতে পারে।'
এখানেও সেই সম্ভাব্যতা- 'ছড়াতে পারে', 'ঘটতে পারে', 'থাকতে পারে'।

অর্থাৎ কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না, কোত্থেকে মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে? তবে ২৩ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে দৈনিক যুগান্তরে 'যুক্তরাষ্ট্রে ছড়াল চীনের ভাইরাস' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, 'জানা গেছে, মূলত সামুদ্রিক খাবার থেকে মানুষ ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হয়েছে।' এই প্রতিবেদনে যেভাবে বলা হয়েছে, 'জানা গেছে', তাতে মনে হয় বিষয়টা অনেকটা নিশ্চিত। কিন্তু দৈনিক যুগান্তরে ২১ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে 'এশিয়ায় ছড়াচ্ছে নয়া ভাইরাস' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, 'ভাইরাস ছোঁয়াচে কিনা, সে ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে গবেষকরা বলেন, যারা চীনের উহান শহরে মাছের বাজারে গিয়েছিলেন, তারা এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। কিন্তু এমন কয়েকজন রোগী পাওয়া গেছে, যারা কোনো মাছের বাজার বা বাজারেই যাননি। অবশ্য এ ভাইরাস সম্পর্কে এখনও খুব বেশি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।'

মাছের বাজারের সাথে এই ভাইরাস সংক্রমণের কোনো সম্পর্কই আর রইলো না। বাকি রইলো বাদুড় আর সাপের মাধ্যমে ছড়ানোর সম্ভাবনা।

বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল আরটিভি'র ওয়েবসাইটে 'প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস বাদুড় থেকে ছড়িয়ে থাকতে পারে' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ২৭ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে। সেখানে বলা হয়, 'এক বিবৃতিতে গবেষকরা জানিয়েছে, উহান করোনাভাইরাসের প্রাকৃতিক হোস্ট বাদুড় হতে পারে; কিন্তু বাদুড় ও মানুষের মাঝখানে একটি অজ্ঞাত মাধ্যম থেকে থাকতে পারে। কিন্তু নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উহান ইন্সটিটিউট অব ভিরোলজির একজন সিনিয়র গবেষক বলেছেন, এই গবেষণার ফলাফল সতর্কভাব নিতে হবে।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে তিনি বলেন, একটি কম্পিউটার মডেলে ক্যালকুলেশনের ভিত্তিতে এই ফলাফল তৈরি করা হয়েছে। বাস্তব জীবনে এটা ঘটবে তা অনিবার্য নয়। বান্ডিং প্রোটিন গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অন্যান্য আরও অনেক কিছুর সঙ্গে এটি নিয়েও তদন্ত করা হচ্ছে। এর সঙ্গে অন্য প্রোটিনেরও সম্পর্ক থাকতে পারে।' [https://www.rtvonline.com/international/84240]

উহান করোনাভাইরাসের প্রাকৃতিক হোস্ট বাদুড় হতে পারে, এই গবেষণা ফলাফলটা সতর্কভাবে নেয়ার কথা বলা হয়েছে এখানে এবং আরো বলা হয়েছে, 'একটি কম্পিউটার মডেলে ক্যালকুলেশনের ভিত্তিতে এই ফলাফল তৈরি করা হয়েছে। বাস্তব জীবনে এটা ঘটবে তা অনিবার্য নয়।'

দৈনিক যুগান্তরে ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে 'মানুষের শরীরে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বনরুই?' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, 'ভোঁদর ও বাদুড়ের পর এবার করোনাভাইরাস সংক্রমণে দায়ী করা হচ্ছে বিপন্ন প্রাণী বনরুইকে। চীনের একদল বিজ্ঞানী বলেন, এই ভাইরাসের আদি পোষক বাদুড় হলেও মানুষের শরীরে বিস্তারে আরেকটি প্রাণীর ভূমিকা রয়েছে। আর সেটি হচ্ছে বনরুই।

গুয়াংজু প্রদেশের দক্ষিণ চায়না কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলছেন, ভাইরাসটির   আরএনএ বিন্যাসের সঙ্গে বনরুইয়ের শরীরে পাওয়া করোনাভাইরাসের বিন্যাসের ৯৯ শতাংশ মিল পেয়েছেন। এ নিয়ে বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।...
ভাইরোলজির ভাষায় এ ধরনের পোষক প্রাণীকে বলা হয় মধ্যবর্তী বাহক। তবে চীনা বিজ্ঞানীদের গবেষণার এই ফল কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সেই প্রশ্ন তুলেছেন যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা। তাদের দাবি, নিশ্চিত করে বলার আগে এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন।
ফ্রান্সের প্যাস্টুয়ার ইনস্টিটিউটের আরনড ফন্টেনেট বলেন, এই রোগ সরাসরি বাদুড় থেকে মানুষের শরীরে বিস্তার ঘটেনি। আমরা মনে করি, মধ্যবর্তী বাহক হিসেবে আরেকটি প্রাণীর ভূমিকা রয়েছে।

গত ৩০ ডিসেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হুঁশিয়ারির পর নতুন করোনাভাইরাস শনাক্ত করে চীন। বিজ্ঞানীরা প্রথম থেকেই ধারনা করে আসছেন যে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটির হুবেই প্রদেশের উহান শহরের একটি সি ফুড মার্কেট থেকে ওই ভাইরাস ছড়িয়েছে।
সি ফুডের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীও ওই মার্কেটে বিক্রি হত, যা পরে বন্ধ করে দেয় চীনা কর্তৃপক্ষ। গোড়ার দিকে সাপ, বাদুড় ও ভোঁদড়ের দিকে ইঙ্গিত ছিল অনেকের।
আবার বিজ্ঞানীদের আরেকটি অংশের বক্তব্য, করোনাভাইরাস সাপকে পোষক হিসেবে ব্যবহার করে, এমন কোনো প্রমাণ কখনও মেলেনি।' [https://www.jugantor.com/international/276045]

এই প্রতিবেদনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সম্পর্ককে বাদুড় ও ভোঁদড় থেকে ছিন্ন করে বনরুইয়ের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। বনরুই সম্পর্কে আবার বলা হয়েছে, 'যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীদের দাবি, নিশ্চিত করে বলার আগে এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন।' আর সাপের সাথে এই ভাইরাসের সম্পর্ক সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'করোনাভাইরাস সাপকে পোষক হিসেবে ব্যবহার করে, এমন কোনো প্রমাণ কখনও মেলেনি।'

দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় 'যেভাবে ছড়াল করোনাভাইরাস' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে। সেখানে বলা হয়, 'নতুন এ প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ কোথা থেকে শুরু হয়েছে সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি বিশেষজ্ঞরা।'

উইকিপিডিয়ায়ও চীনের উহানের মানুষকে ব্যাপকহারে আক্রমণকারী এই রোগকে 'অজ্ঞাত কারণে নিউমোনিয়া' বলেই আখ্যায়িত করা হয়েছে '2019–20 Wuhan coronavirus outbreak (উইকিপিডিয়ার নিবন্ধগুলো হালনাগাযোগ্য)' শিরোনামের একটি নিবন্ধে। নিবন্ধটির শিরোনাম বেশ কয়েকবার পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমান শিরোনাম '2019–20 coronavirus pandemic'। বলা হয়েছে, 'In Wuhan, during December 2019, a cluster of cases displaying the symptoms of a "pneumonia of unknown cause" was linked to Huanan Seafood Wholesale Market, which had a thousand stalls selling fish, chickens, pheasants, bats, marmots, venomous snakes, spotted deer, and other wild animals (ye wei, bushmeat). In January 2020, the hypothesis was that this was a novel coronavirus from an animal source (a zoonosis).' [https://en.wikipedia.org/wiki/2019%E2%80%9320_coronavirus_outbreak]

সুতরাং করোনাভাইরাস কোত্থেকে জন্ম নিল, এই প্রশ্নের কোনো উত্তরই এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এখনো এর কারণ অজ্ঞাত। আমরা আর কোনো উত্তর নিয়ে না ভেবে আপাতত দেখি, এই ভাইরাস সত্যিই মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় কিনা? এটা কি সত্যিই কোনো 'ভাইরাস', যা এক শরীর থেকে আরেক শরীরে সংক্রমিত হবার শক্তি রাখে?


Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)
To Top